
ছবিঃ বিপ্লবী বার্তা
একসময় যোগাযোগ, সেচ ও মৎস্যসম্পদ হিসেবে নদী ছিল অঞ্চলগুলোর প্রাণকেন্দ্র। কৃষিকাজের উর্বরতা, সামুদ্রিক-মিঠা জলচক্র ও স্থানীয় জীবনজীবিকার ভিত্তি সবকিছুই নদীর সুষ্ঠু প্রবাহের ওপর নির্ভর করত। কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের ব-দলীয় অঞ্চলগুলোতে নদী, খাল ও জলাশয় গজিয়ে ওঠা চরের কারণে ভরাট ও নাব্যতা হ্রাসে বড় ধরনের পরিবেশগত ও সামাজিক সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।
গঙ্গা-তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের নীচে ব-দলীয় পলিমাটি অঞ্চলে বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে বয়ে আসা খরস্রোতা পলি নদীতীর ভাঙন ও তলদেশের পলি সঞ্চয়ের মাধ্যমে চর সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে নদীপাড়ের বৃক্ষনিধন, স্লুইজগেট ও বাঁধ-সেচ প্রকল্প, অপরিকল্পিত সড়ক ও কালভার্ট নির্মাণ, কলকারখানা ও আবাসিক স্থাপনা নির্মাণ, অবৈধ নিষ্কাশন এবং খাল দখল ও ভরাট এসব মানুষের তৈরি কার্যক্রম নদীর নাব্যতা দ্রুত কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে নৌযান চলাচলে সমস্যা তৈরি হওয়া ছাড়াও কৃষি সেচ, মাছচাষ ও স্থানীয় পানি সরবরাহ সংকুচিত হচ্ছে।
বর্ষাকালে ভরাট খাল ও বাধাগ্রস্থ প্রবাহ পানির ঠিকঠাক নিঃসরণ বাধাগ্রস্ত করে বন্যার মাত্রা বাড়ায়; আর শুকনো মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় নৌ চলাচল থমকে যায়, কৃষি ও মৎস্যচাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শহরগুলোর পানির সরবরাহ, মাটির উর্বরতা ও সামুদ্রিক প্রাণিসম্পদের জীবনচক্রও এ থেকে প্রভাবিত হচ্ছে।
সমস্যার শিকড় চিহ্নিত করতে গবেষণা ও ভূগর্ভস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে তথ্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বর্ষায় পাহাড়ি উজান থেকে বেশিরভাগ পলি আসে ও নদীতীর ভাঙন বাড়ে; অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলের পলিমাটির দ্রবীভূত গুনের কারণে একবার পানিতে ভেসে এলে মাটি সহজে চলে যায়। স্লুইজগেট ও বাঁধ নির্মাণের অভাবে খালগুলি ভরাট হয়ে নাব্যতা কমেছে। ঠিকাদাররা কালভার্ট নির্মাণ করে রাখলেও জলবহাবের পথ সচল রাখে না।
সমাধানের জন্য করণীয় অনির্বচনীয় বলে একযোগে উঠে এসেছে ড্রেজিং করে খাল ও নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা, অপরিকল্পিত বাঁধ অপসারণ, অপদখলকৃত নদী ও জলাশয় উদ্ধার, পাহাড়কাটা বন্ধ এবং কলকারখানার পাশে বর্জ্য পরিশোধন ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বাধ্যতামূলক করা। পাশাপাশি গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও ফেনীর মতো আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানির ন্যায্যতা নির্ধারণ করে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পানির হিস্যা চূড়ান্ত করতে হবে। নদীকে তার প্রাকৃতিক গতিপথে চলতে দেয়া ও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন যুগোপযোগী করে কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করাও একান্ত প্রয়োজন।
তবে কেবল আইনই নয় প্রয়োজনে সামাজিক সচেতনতা, এনজিও ও স্থানীয় সংগঠনগুলোর সমন্বিত উদ্যোগ, প্রশাসনিক সমন্বয় ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া খাল-নদীর পুনরুজ্জীবন সম্ভব নয়। গবেষণা অনুযায়ী, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও স্বার্থান্বেষী দখলের কারণে বহু খাল অবৈধভাবে দখল ও বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে; দুর্নীতি, মামলা-হামলার ভয় ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এসব অপচেষ্টা মুক্ত করা যাচ্ছে না। এসব ভাঙচুর রোধে স্থানীয় জনগণকে সংহত করে পরিবেশ রক্ষায় আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা অপরিহার্য।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নদী ও জলাশয়কে রক্ষা করা মানে মূলত জনপদের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। তাই প্রশাসন, আদালত, স্থানীয় সরকার, কেলেঙ্কারি রোধকারী সংস্থাদি ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেই নদী-জলাশয়ের টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে, না হলে নদীর মৃত্যু মানেই আঞ্চলিক জনপদের ক্রমশ ক্ষয় আর একতরফা বিপর্যয়।