
রুপালি পর্দার আলো নিভে গেছে অনেক আগেই। একসময় যিনি ছিলেন সিনেমাপ্রেমীদের হৃদয়ের কেন্দ্রবিন্দু, যাঁর হাসি-অভিনয়ে মুখর থাকত সিনেমা হল, সেই বনশ্রীর জীবনের শেষ দৃশ্যটা ছিল একদম নিঃশব্দ, একাকী।
মঙ্গলবার সকালে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলেন নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় এই নায়িকা। পাশে ছিলেন না কোনো পরিচালক, প্রযোজক বা সহশিল্পী, ছিল শুধু একমাত্র ছেলে মেহেদী হাসান, ছোট ভাই হারুন শিকদার এবং কয়েকজন আত্মীয়স্বজন। সন্ধ্যার পর নিঃশব্দে তাঁকে সমাহিত করা হয় নানাবাড়ির কবরস্থানে। আলো ঝলমলে দিনগুলো যেন অতীতের ইতিহাস হয়ে রইল।
বনশ্রীর ভাই হারুন শিকদার জানান, কয়েক মাস ধরেই তাঁর বোন নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর দুই মাস আগে তিনি শিবচরে চলে যান। পাঁচ দিন আগে অসুস্থ হয়ে নিজেই ভর্তি হন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে কয়েকদিন চিকিৎসা চলার পর মঙ্গলবার সকালে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
বাংলা চলচ্চিত্রে বনশ্রীর যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সোহরাব-রুস্তম’ সিনেমার মাধ্যমে। নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের বিপরীতে অভিনীত এই ছবি ব্যবসায়িকভাবে সফল হয় এবং রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন বনশ্রী। এরপর একে একে তিনি মান্না, রুবেল, আমিন খানের মতো জনপ্রিয় নায়কদের সঙ্গে ৮-১০টি ছবিতে অভিনয় করেন। গান, নাচ, শুটিং সেট, ক্যামেরার ঝলকানি—সব মিলিয়ে তখন তাঁর জীবন ছিল রঙিন সিনেমার মতোই।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্টে যায় জীবনের চিত্রনাট্য। সিনেমা থেকে দূরে সরে গিয়ে বনশ্রীর জীবন হয়ে ওঠে এক কঠিন সংগ্রামের গল্প। সংসার চালাতে গিয়ে কখনো শাহবাগে ফুল বিক্রি করেছেন, কখনো বাসে বাসে হকারি করেছেন। নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,“চলচ্চিত্র ছেড়ে দেওয়ার পরই আর্থিক অনটনে পড়ি। শাহবাগে ফুলের ব্যবসা করেছি। বাসে বাসে হকারিও করতে হয়েছে তিন বেলা খাবার জোগাড় করতে।”
শেষ সময়ে ফিরে যান নিজের জেলা মাদারীপুরের শিবচরে। সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পে একটি ছোট ঘর পান তিনি। সরকারি অনুদানের সুদই ছিল তাঁর একমাত্র আয়ের উৎস। এক সময়কার জনপ্রিয় নায়িকা তখন গ্রামের এক কোণে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করতেন। খ্যাতি, করতালি, ক্যামেরার ঝলক তখন শুধুই অতীতের গল্প।
বনশ্রী ১৯৪৪ সালের ২৩ আগস্ট মাদারীপুরের শিবচরের শিকদারকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মজিবুর রহমান মজনু শিকদার ও মা সবুরজান রিনা বেগমের দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়। সাত বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। সেখান থেকেই শুরু হয় রুপালি পর্দায় যাত্রা এবং পরবর্তীতে আলো ঝলমলে এক তারকাজীবন।
শেষ অধ্যায়ে এসে বনশ্রীর জীবন যেন হয়ে উঠল নিঃসঙ্গতার এক করুণ কাহিনি। আলো, ক্যামেরা ও করতালির বাইরে এক নীরব পরিসমাপ্তিতে শেষ হলো তাঁর জীবনের গল্প।