আগাছায় ভরা জমি আজ ফল-সবজির রাজ্য
ছবিঃ বিপ্লবী বার্তা

একসময় পাইকগাছার দেলুটি ইউনিয়নের ২২ নম্বর পোল্ডারের ৩৪ একর জমি ছিল পরিত্যক্ত। যেখানে ছিল আগাছা, বিষাক্ত সাপ, পোকামাকড় আর ইঁদুরের অভয়ারণ্য। সেই অবহেলিত জমি আজ পরিণত হয়েছে সবুজ ফসলের রাজ্যে। দীর্ঘদিন অব্যবহৃত পড়ে থাকা খালের দুই পাড় পরিস্কার করে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক কৃষি খামার। আর এই অপূর্ব রূপান্তরের নেপথ্যে রয়েছেন অদম্য কৃষি উদ্যোক্তা বিধান মণ্ডল। বর্তমানে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কৃষক, প্রকৃতি প্রেমী ও দর্শনার্থীরা এই খামার পরিদর্শনে আসছেন। খামারের সবুজে ঘেরা চিত্র দেখে মুগ্ধ হচ্ছেন দর্শনার্থী ও স্থানীয় বাসিন্দারা।


৮০ দশকে পাইকগাছায় লবণ পানির চিংড়ি চাষ শুরু হয়। অতি মুনাফার আশায় চিংড়ি চাষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পুরো উপজেলায়। তবে দেলুটি ইউনিয়নের ২২ নম্বর পোল্ডারে লবণ পানি প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এখানকার মানুষ ধান ও তরমুজ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কালিনগর-সেনেরবেড় এলাকার একটি গুরুত্বপূর্ণ খাল হলো ডিহিবুড়া খাল। কয়েক বছর আগে সরকার এই খালটি পুনঃখনন করে। বৃষ্টির পানির উৎস এই খালের পানি ব্যবহার করে স্থানীয় কৃষকরা হাজার হাজার বিঘা জমিতে তরমুজ চাষ করেন। পরে সরকার মাছ চাষের জন্য খালটি ইজারা দেয় সোনার বাংলা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিকে। স্থানীয়দের আপত্তির মুখে উদ্যোক্তা বিধান মণ্ডল ১৫ একর খালের মধ্যে ২ একর রেখে বাকি ১৩ একর উন্মুক্ত করে দেন। দুই একর খালে তিনি গলদা ও কার্প জাতীয় মাছ চাষ করছেন। খালের দু’পাড়ের জমি আগাছা ও জঙ্গল পরিষ্কার করে ৩৩ একর পতিত জমিকে চাষের আওতায় এনে গড়ে তোলেন আধুনিক কৃষি খামার।


বিধান মণ্ডলের উদ্যোগে এখন সেই খালপাড়ের জমি থেকে উঠছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফল-ফসল। খামারের মাচায় ঝুলছে ১১ জাতের অফসিজন তরমুজ, ৮ জাতের সামমাম, ৬ জাতের বাঙ্গিসহ মোট ১৭৩ জাতের ফল ও সবজি। সবজি খেতের ভেতর দেখা যাচ্ছে লাউ, করলা, বরবটি, মিষ্টি কুমড়াসহ নানা জাতের শাকসবজি। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক এখানে কাজ করছেন। ফলে শুধু কৃষিই নয়, সৃষ্টি হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতিতে নতুন কর্মচাঞ্চল্য।


কৃষক বিধান মণ্ডলের হিসেবে, ৩০ হাজার তরমুজ গাছে প্রতিটি গাছে গড়ে ২-৩টি করে ফল ধরছে। এতে উৎপাদন হবে অন্তত ৬০-৬৫ হাজার তরমুজ। প্রতিটির ওজন ২.৫ থেকে ৮ কেজি পর্যন্ত। বাজারদর কেজিপ্রতি ৪০ টাকা হলে তরমুজ বিক্রি হবে প্রায় ৬০-৬৫ লাখ টাকার। একইভাবে ২৪ হাজার সামমাম গাছে প্রতিটি গাছে ৩-৪টি করে ফল ধরছে, প্রতিটির ওজন ৫০০ গ্রাম থেকে দেড় কেজি পর্যন্ত। বাজারদর কেজিপ্রতি ৬০ টাকা হলে সামমাম বিক্রি হবে প্রায় ১৫ লাখ টাকার। এছাড়া বিভিন্ন জাতের করলা, লাউ, বরবটি প্রভৃতি সবজি সপ্তাহে ২০০ কেজি হারে বাজারজাত হচ্ছে। সব মিলিয়ে তার খরচ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ লাখ টাকা আর প্রত্যাশিত আয় কোটি টাকারও বেশি, যা তিনি তিন মাসের মধ্যেই তুলতে পারবেন বলে আশা করছেন।


স্থানীয় জমির মালিক কাত্তিক চন্দ্র সরদার বলেন, “বিধান মণ্ডল খালের দু’পাড়ে আমাদের পরিত্যক্ত জমি কাজে লাগিয়ে শুধু ফসল ফলাননি, আমাদেরও নতুন স্বপ্ন দেখিয়েছেন। এখন আমরাও কৃষিকাজে আগ্রহী হয়ে উঠছি।” পাশের গ্রামের শ্রীকান্ত হালদার বলেন, “বিধান বাবুর অভূতপূর্ব ফল ও ফসল উৎপাদন দেখতে এসেছি। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এ কৃষি প্রজেক্ট দেখতে আসে। আগামীতে আমরাও আধুনিক কৃষিতে যুক্ত হবো।”


উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুমিত দেবনাথ বলেন, “বিধান বাবুর আধুনিক কৃষি প্রজেক্টের সবধরনের সমস্যা ও সম্ভাবনায় উপজেলা কৃষি অফিস কাজ করছে।” বিধান মণ্ডল জানান, তিনি ইউটিউব চ্যানেল ও কৃষি গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে উন্নতমানের বীজ সংগ্রহ করেছেন। সার প্রয়োগে জৈবসার ব্যবহার করেছেন এবং রোগবালাই দমনে বহুজাতিক সিনজেনটা কোম্পানির জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করছেন। তিনি বলেন, “আমি চেষ্টা করেছি আধুনিক প্রযুক্তি আর স্থানীয় মানুষের সহায়তায় কিছু করার। আগামী ২০ দিনের মধ্যে বাজারজাত শেষ হবে, ভালো দাম আশা করছি।”


তবে এই সাফল্যের মাঝেও বিধানের রয়েছে কিছু দুশ্চিন্তা। তার অন্যতম সমস্যা হলো দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থা। তিনি বলেন, “ফসল বাজারজাত করতে ভাঙা রাস্তা আর দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে আমাকে অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি এই সমস্যা সমাধান করে, তবে আমাদের মতো কৃষকদের স্বপ্ন আরও বড় আকারে বাস্তবায়িত হবে।”


এক সময় যে খালপাড় ছিল আগাছায় ভরা অন্ধকার, আজ সেখানে ভোরের রোদে ঝলমল করছে সবুজ ফসলের সমারোহ। কৃষক বিধান মণ্ডলের হাত ধরে পাইকগাছায় যে সবুজ বিপ্লব ঘটছে, তা শুধু কৃষি উৎপাদনই নয়, বরং কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে উঠছে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার মো. মনিরুল হুদা জানান, দ্বীপ বেষ্টিত দেলুটি ইউনিয়নের কালীনগর এলাকায় বিধান মণ্ডল পতিত জমিতে আধুনিক কৃষি প্রজেক্ট তৈরি করেছেন। সেখানে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাতের ফল ফসল উৎপাদন করে তিনি সাড়া ফেলেছেন। উপজেলা কৃষি অফিস তার পাশে থেকে কাজ করছে।