'শাহবাগ'_ আন্দোলনের মুখোমুখি নগরজীবন
ছবিঃ বিপ্লবী বার্তা

বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে শাহবাগ নামটা বেশি একটা পুরোনো নয়।ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই শাহবাগ মোড়, একসময় ছিল কেবল একটি ব্যস্ত ট্রাফিক চত্ত্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, জাতীয় জাদুঘর ও রমনা পার্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানঘেরা এ মোড়টি নগরে চলাচলের জন্য একটি অন্যতম সংযোগস্থল। কিন্তু বর্তমানে যেীক্তিক ও অযেীক্তিক সকল দাবি আদায়ের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

শুরোটা হয়েছিল ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে , দাবি ছিল ৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। যদিও এটি ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের তথা বিরোধী মত দমনের অন্যতম হাতিয়ার ও ফ্যাসিবাদের সূচনা। এই গণজাগরণ মঞ্চের তৈরিকৃত ঐতিহাসিক “প্রজন্ম চত্বরের” আন্দোলনের পর থেকে শাহবাগ আর শুধু একটি মোড় নয়, হয়ে উঠেছে জনঅসন্তোষ ও রাজনৈতিক-সামাজিক দাবির প্রতীক। বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী গোষ্ঠীর কর্মসূচির কারণে এই এলাকায় প্রায়শই যান চলাচল বন্ধ থাকে, যার ফলে নগরবাসী চরম দুর্ভোগে পড়েন।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রয়োজনীয় হবে এটা স্বাভাবিক, কিন্তু সেটার প্রভাব যদি নাগরিক জীবনের স্বকীয়তা নষ্ট করে দেয়, তবে সেটি নিয়ে ভাববার সময় এসেছে। শাহবাগে আন্দোলনের কারণে বরাবরই বন্ধ হয়ে যায় আজিজ সুপার মার্কেট থেকে বাংলামোটর পর্যন্ত রাস্তা। অ্যাম্বুলেন্স আটকে থাকে, অফিসগামী মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে পড়ে থাকেন, এমনকি স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরাও ভোগান্তির শিকার হন। জরুরি রোগী বহনের ক্ষেত্রেও এই প্রতিবন্ধকতা মারাত্মক ফল বয়ে আনে।

এই প্রেক্ষাপটে সরকারের দায়িত্ব ও ভূমিকা এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি। ২০২৪ সালের প্রথমদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় সংঘটিত রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রশাসনের একাধিক পর্যায়ে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে দেশের রাজনীতি নতুন মোড় নেয়। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে একাধিক মন্ত্রণালয়ের অব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অবহেলার প্রতিবাদে সারাদেশে প্রায় ৮৭টি জায়গায় বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়, যার মধ্যে শাহবাগ ছিল সবচেয়ে আলোচিত। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) হিসাবে শুধুমাত্র জানুয়ারি-মার্চ এই তিন মাসে শাহবাগ এলাকায় সহ অন্যান্য স্থানে আন্দোলনের কারণে যানজটে শহরের গড় কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় প্রায় ১২ লাখ ঘন্টা—যার অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল আনুমানিক ৩৬০ কোটি টাকা।

প্রশ্ন উঠছে, এই ক্ষতির দায় কে নেবে? আন্দোলনের স্থান নির্ধারণ করে তা ঠেকানো কি সমাধান, নাকি সমস্যা অনুযায়ী সমাধান নিশ্চিত করাই সরকার ও মন্ত্রণালয়গুলোর কাজ?

প্রথমত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন, শ্রম, পরিবেশ ইত্যাদি খাতভিত্তিক মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্ব হচ্ছে দ্রুত সমস্যা শনাক্ত করে, আগেভাগেই বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যেমন ২০২৪ সালের আন্দোলনগুলোর মধ্যে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা বাতিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ বাণিজ্য এবং ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি ছিল প্রধান ইস্যু। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর ছিল সরাসরি উত্তেজনার কারণ।

দ্বিতীয়ত, ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রশাসনিক কাঠামোতে বারবার দেখা গেছে জনআস্থা যখন দুর্বল হয়, তখন সুশাসন আর জবাবদিহিতার অভাবেই রাজপথ হয়ে ওঠে মানুষের একমাত্র আশ্রয়স্থল। জনগণের মৌলিক চাহিদা উপেক্ষিত হলে তারা আর সংবিধানের ধারা দেখে না, তারা দেখে ন্যায়বিচার কোথায় নেই, আর তা ফেরত পেতে হলে কোথায় দাঁড়াতে হবে।

তৃতীয়ত, আন্দোলনের স্থান নির্ধারণ নয়, বরং সরকারকে এখন দরকার সমস্যা অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর দায় নির্ধারণ এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করার একটি বাস্তব কাঠামো দাঁড় করানো। এই কাঠামোতে থাকবে ব্যবস্থাপনা কমিটি, জনঅভিযোগ গ্রহণের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এবং জরুরি সমস্যার সমাধানে সর্বোচ্চ কম সময়ের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ নিশ্চিত করার নীতি।

জনগণের আস্থা হারালে রাস্তার রাজনীতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। যে সমাজে সমস্যা উপেক্ষিত হয়, সেখানে প্রতিবাদ জন্ম নেয় নিজস্ব ভাষায়। তাই আন্দোলন নয়, সমাধানই হোক রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়িত্ব। সমস্যার আগেই সমাধানের দ্বার খুলে দিলে শাহবাগ কখনোই আর বিক্ষোভের কেন্দ্র নয়, বরং হয়ে উঠতে পারে আলোর চত্বর; যেখানে জনগণ আসে আস্থা নিয়ে, ক্ষোভ নিয়ে নয়।