অবৈধ শিকার ও পাচারে বিপন্ন সুন্দরবনের হরিণ
ছবিঃ বিপ্লবী বার্তা
সুন্দরবন, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, বাংলাদেশ ও ভারত জুড়ে বিস্তৃত। এর মোট আয়তন প্রায় ১০,০০০ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে বাংলাদেশের অংশ ৬,০১৭ বর্গকিলোমিটার এবং ভারতের অংশ ৩,৯৮৩ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের সুন্দরবন খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা জুড়ে বিস্তৃত এবং দুইটি বন বিভাগে বিভক্ত— সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ (বাগেরহাট) ও সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ (খুলনা)।



সুন্দরবনে মোট ৩৭৫ প্রজাতির বন্যপ্রাণী রয়েছে। ২০১৮ সালের বাঘ শুমারিতে সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বিভাগে প্রায় ১,৪২,০০০ হরিণের হিসাব পাওয়া যায়। তবে বর্তমানে হরিণ শিকারের কারণে এ সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাসের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাগেরহাট জেলার বনাঞ্চল ১,৮৩৪.৭৪ বর্গকিলোমিটার, যা সুন্দরবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে ছয়টি ফরেস্ট স্টেশন রয়েছে— বিভাগীয় অফিস (সুন্দরবন পূর্ব, বাগেরহাট), বগী ফরেস্ট অফিস, চাঁদপাই স্টেশন অফিস, জেলেপল্লী টহল ফাঁড়ি (দুবলা), ধানসাগর ফরেস্ট অফিস এবং শরণখোলা স্টেশন অফিস।



সুন্দরবনের চারপাশের বিভিন্ন ভোক্তা শ্রেণির চাহিদার কারণে হরিণ শিকার বেড়েই চলেছে। বেপরোয়া শিকারি চক্র বন বিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। নাইলনের রশি ব্যবহার কমে স্টেইনলেস স্টিলের তার ব্যবহার হচ্ছে, যা বনভূমির আলো-ছায়ায় প্রায় অদৃশ্য। শিকারিরা হরিণ শিকার করে সোনাতলা ও পানির ঘাট এলাকা দিয়ে মাংস পাচার করছে।



স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বরগুনার পাথরঘাটা, কাঠালতলি, জ্ঞানপাড়া ও মঠবাড়িয়া এলাকায় সক্রিয় চক্রগুলো রাতের আঁধারে কচিখালি, চান্দেশ্বর ও ডিমের চর এলাকায় ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে পাচার করছে। শিকারিরা জেলে, মৌয়াল, কাঠুরিয়া ও কাঁকড়া সংগ্রাহক সেজে বনভূমিতে প্রবেশ করছে এবং পরে যন্ত্রপাতি একত্র করে ফাঁদ তৈরি করছে।


বন বিভাগ সূত্রে জানানো হয়েছে, জুন থেকে আগস্টের মধ্যে সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও হরিণ শিকার কমেনি। এ সময়ে ১৮৯টি অভিযোগ, ৯৪টি মামলা, ১৪৮ জন গ্রেপ্তার এবং ২৪,০০০ ফুট মালাফাঁদ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ৬০০ হাটাফাঁদ ও ১৩০ ছিটকা ফাঁদ ধ্বংস করা হয়েছে।


সুন্দরবনের বনরক্ষীরা কঠোর পরিশ্রম করছেন। প্রতিদিন প্রায় ১,৮০০ হেক্টর বন পাহারা দিতে হয়। জোয়ারের সময় পানিতে ডুবে সাঁতার কেটে পাহারা দিতে হয়। পূর্ব সুন্দরবন বিভাগে জনবল ৪২৬ জনের মধ্যে ১৫০ জনের লোকবল সংকট রয়েছে। বনরক্ষীদের সরঞ্জাম, জলযান ও স্বাস্থ্য সেবার সীমাবদ্ধতা শিকার প্রতিরোধ কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করছে।


হরিণ শিকার ও তার কারণ

হরিণ শিকার বৃদ্ধির মূল কারণগুলো হলো, 

১. অর্থনৈতিক লাভ: হরিণের মাংস ও চামড়ার চাহিদা।

২. সহজলভ্য শিকার: শুষ্ক মৌসুমে হরিণ সহজে ধরা পড়ে।

৩. আইন প্রয়োগের অভাব: শিকারিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়া।

৪. দারিদ্র্যতা: সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার দরিদ্র মানুষ পেটের দায়ে শিকার করে।

৫. অগ্রিম দাদন: কিছু মাংস প্রেমিক আগাম অর্থ দিয়ে শিকার উৎসাহিত করে।

৬. বন বিভাগের সীমাবদ্ধতা: জনবল ও উপকরণের অভাব।


করণীয় ও প্রস্তাবিত পদক্ষেপ

১. সুন্দরবন রক্ষায় সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, 

২. বন বিভাগের জনবল বৃদ্ধি ও সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা।

৩. নিরাপদ ও দ্রুতগতির পর্যাপ্ত জলযান সরবরাহ।

৪. বনরক্ষীদের স্বাস্থ্য সেবা ও আবাসন নিশ্চিত করা।

৫. হরিণ শিকার প্রতিরোধে জীবনরক্ষা উপকরণ সরবরাহ।

৬. কঠোর শাস্তি ও জরিমানা নিশ্চিত করা।

৭. বন কর্মকর্তাদের নিয়মিত বন পরিদর্শন।

৮. তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার ও বনরক্ষীদের পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা।

৯. স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও স্থানীয় জনগণকে সংরক্ষণ কার্যক্রমে যুক্ত করা।

১০. বন বিভাগের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।


সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবীর বলেন, “সুন্দরবনে হরিণ শিকার সহজে বন্ধ হচ্ছে না। কিছু মানুষ হরিণের মাংস খাওয়াতে পারলেই বড় অর্জন মনে করছে। হরিণ শিকার সম্পূর্ণ অবৈধ। সবাইকে সচেতন হতে হবে।”


সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোঃ রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “জনবল সংকট ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও বনরক্ষীরা কঠোর পরিশ্রম করছেন। শিকারিদের নতুন কৌশল সত্ত্বেও আমরা নিয়মিত টহল চালাচ্ছি। হরিণ নিধন রক্ষার্থে সকলকে এগিয়ে আসা উচিত।”