
একুশ শতকের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে প্রযুক্তি ছাড়া জীবন কল্পনা করাই দুঃসাধ্য। কম্পিউটার, স্মার্টফোন, কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা—সবকিছুই যেন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ যুগে প্রযুক্তির উপস্থিতি এতটাই ব্যাপক যে এক মুহূর্তের জন্যও এর অনুপস্থিতি চিন্তা করা কঠিন। তবে এর মাঝেই একটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার কি আমাদের ভুলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে?
প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে জীবনধারায় বড় পরিবর্তন এসেছে, যা আগেও দেখা গেছে। করোনা মহামারির সময় হোম অফিস যেমন বাস্তবতা হয়ে উঠেছিল, তেমনি আজকের দিনে তথ্য খুঁজতে আর আগের মতো কষ্ট করে সার্চ দিতে হয় না—এআই সেই কাজ এখন করে দিচ্ছে চোখের পলকে। সময় ও পরিশ্রম বাঁচলেও, এই আরামদায়ক জীবনধারা মস্তিষ্কের ওপর কী প্রভাব ফেলছে—সেই প্রশ্নই এখন গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু।
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস এবং বেলোর ইউনিভার্সিটির একটি যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে ভিন্নতর তথ্য। প্রায় ৪ লাখ ১১ হাজার পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষের ওপর চালানো ৫৭টি গবেষণায় দেখা গেছে—যে কথাটি এত দিন বলা হচ্ছিল, অর্থাৎ প্রযুক্তি স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দেয়—তার বাস্তব ভিত্তি নেই। বরং এই গবেষণাগুলো বলছে, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার বয়সজনিত স্মৃতিভ্রংশের হার অনেকটাই কমিয়ে দিতে পারে। ‘নেচার হিউম্যান বিহেভিয়ার’ জার্নালে প্রকাশিত এই গবেষণায় বলা হয়, যাঁরা নিয়মিত প্রযুক্তি ব্যবহার করেন, তাঁদের স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৫৮ শতাংশ কমে যায়।
তবে 'ডিজিটাল ডিমেনশিয়া'—এই ধারণাটি প্রথম সামনে এনেছিলেন জার্মান স্নায়ুবিজ্ঞানী ম্যানফ্রেড স্পিৎজার, ২০১২ সালে। তাঁর মতে, মানুষ এখন এত বেশি সময় পর্দার সামনে কাটায় এবং যান্ত্রিকভাবে প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে, যে সহজ তথ্যও তারা আর মনে রাখে না। উদাহরণস্বরূপ, একসময় প্রিয়জনের ফোন নম্বর মুখস্থ থাকত, কিন্তু এখন আমরা তা ফোনে সংরক্ষণ করে রাখি এবং মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করি না। প্রযুক্তির এমন ব্যবহারে মনোযোগ এবং শেখার আগ্রহ কমে যায় বলে দাবি করা হয়।
কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো বলছে, বিষয়টি একপেশে নয়। স্মৃতিশক্তি ক্ষয়ের পেছনে প্রযুক্তি একমাত্র কারণ নয়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, পারিবারিক পরিবেশ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও তা নির্ভর করে। এমনকি গবেষণায় উঠে এসেছে যে, স্মার্টভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার শারীরিক ব্যায়াম বা রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের চেয়েও বেশি উপকারী হতে পারে।
তবে শর্ত একটাই—প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে হবে সচেতনভাবে। পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষদের মধ্যে যাঁরা শুধু ফেসবুক স্ক্রল বা ইউটিউব ভিডিও দেখে সময় কাটান, তাঁদের মস্তিষ্কের সৃজনশীল ব্যবহার কমে যায়। কিন্তু যদি তাঁরা এমন কনটেন্টে মনোযোগ দেন, যা চিন্তা, বিশ্লেষণ বা শেখার আগ্রহ তৈরি করে, তাহলে মস্তিষ্ক সচল থাকবে এবং ভুলে যাওয়ার প্রবণতা কমে আসবে। একইসঙ্গে তাঁরা অনলাইনের গুজব বা বিভ্রান্তিকর তথ্য থেকেও সুরক্ষিত থাকতে পারবেন।
সুতরাং, প্রযুক্তি আমাদের মস্তিষ্কের শত্রু নয়—বরং সেটি হতে পারে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার। সব নির্ভর করছে, আমরা সেটিকে কীভাবে ব্যবহার করছি তার ওপর।