ছবিঃ বিপ্লবী বার্তা
বগুড়ার শেরপুরে দাঁড়িয়ে আছে এক প্রাচীন সাক্ষী, যার নীরব দেয়ালে লুকিয়ে আছে সাড়ে চারশ বছরের গল্প। সময় বদলেছে, যুগ পাল্টেছে, মানুষ এসেছে-গেছে; কিন্তু খেরুয়া মসজিদ যেন সময়কে থামিয়ে রেখেছে নিজের ভেতর। মুগল স্থাপত্যের বর্ণিল নিদর্শনটি শুধু ইট-চুনের স্থাপনা নয়, এটি এক অমূল্য ইতিহাসের গর্ভ।
বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে, শেরপুরের খন্দকারটোলা গ্রামের সবুজ-নিরিবিলি পরিবেশের মধ্যেই হঠাৎ চোখে পড়ে লাল-ধূসর রঙের এক অদ্ভুত নীরবতা খেরুয়া মসজিদ। সীমানা প্রাচীর পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই যেন শোনা যায় শতাব্দী পেরোনো মানুষের পায়ের শব্দ। প্রতিষ্ঠাতা আব্দুস সামাদ ফকিরের কবরটি দর্শনার্থীদের যেন নীরবে আহ্বান করে “এসো, আমার গড়া ইতিহাসটা জানো।”
ইতিহাস বলে, সুলতানি আমলের সরলতা আর মুগলদের সুদৃশ্য স্থাপত্যশৈলীর অবিশ্বাস্য মেলবন্ধনেই গড়া খেরুয়া মসজিদ। মীর্জা নবাব মুরাদ খানের পৃষ্ঠপোষকতায় ৯৮৯ হিজরি বা ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া এ নির্মাণকাজ ছিল সময়ের জন্য এক সাহসী উদ্যোগ।
বাইরে থেকে মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৭ ফুট, প্রস্থ ২৪ ফুট। কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই বোঝা যায় দেয়ালের প্রায় ৬ ফুট পুরুত্ব ইতিহাসের প্রতিটি ঝড়-ঝাপটা সহ্য করে তাকে আজ অবধি রাখার জন্যই তৈরি। মসজিদের তিনটি গম্বুজ, চার কোনার চারটি মিনার সব মিলিয়ে যেন এক রাজসিক স্থিরতা ছড়িয়ে রেখেছে চারপাশে।
পূর্ব দেয়ালের তিনটি, উত্তর ও দক্ষিণের আরও দুটি দরজা দর্শনার্থীদের স্বাগত জানায়। ভেতরে রয়েছে তিনটি মেহরাব, আর তার ওপরে ধনুকাকৃতির কার্নিশের নিচে সারি সারি খিলান মুগলদের ঐতিহ্য যেন ইটের ভাঁজে ভাঁজে খেলা করছে। দেয়ালের কিছু অংশে এখনো পাওয়া যায় পোড়া মাটির অলংকরণ। যদিও সংখ্যায় কম, তবু এগুলো যেন মসজিদের গায়ের দুল মৃদু ঝলক দিয়ে মনে করিয়ে দেয়, “আমি অমূল্য।”
মসজিদের সামনের দেয়ালে ছিল দুটি শিলালিপি। কথিত আছে, একটি শিলালিপির ভেতরে ছিল মূল্যবান সম্পদ, যা পরবর্তীকালে ব্যবহৃত হয়। অন্য শিলালিপিটি এখন করাচি জাদুঘরে সংরক্ষিত বাঙলার প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে।
একসময় অবহেলার ধাক্কায় মসজিদটি প্রায় হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। দেয়ালে ফাটল, গম্বুজে শ্যাওলা, পথঘাটে আগাছা সব মিলিয়ে মসজিদটি যেন নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছিল। পরে নব্বইয়ের দশকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এগিয়ে এলে আবার ফিরে পায় তার পুরোনো মর্যাদা। যদিও মসজিদে যাওয়ার কাঁচা পথটি এখনও দর্শনার্থীদের জন্য ভ্রমণকে কিছুটা কঠিন করে তোলে।
চারশো বছরের বেশি সময়ের পথচলার পরও খেরুয়া মসজিদ আজও নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে। দিনের আলোতে যেমন এর স্থাপত্য দর্শকদের মুগ্ধ করে, রাতের নিস্তব্ধতায় তেমনি মনে হয় যেন এর দেয়াল ফিসফিস করে বলে, “আমি ইতিহাসের সন্তান। আমাকে দেখতে এসো, আর সময়ের গল্প শুনে যাও।”

