
সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্র একসময় বড়, মাঝারি ও ছোট পাথর আর পাহাড়ি স্বচ্ছ জলধারার জন্য বিখ্যাত ছিল। পর্যটকেরা এখানে এসে পাথরের ওপর বসে ছবি তুলতেন, উপভোগ করতেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য।
কিন্তু সেই দৃশ্য এখন অতীত। গত চার মাসে এখানকার প্রায় ৮০ শতাংশ পাথর প্রকাশ্যে লুট হয়ে গেছে। লুটপাটের বিষয়টি স্থানীয় মানুষ থেকে শুরু করে প্রশাসন পর্যন্ত সবার জানা ছিল, সংবাদমাধ্যমেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। তবুও প্রশাসনের উদ্যোগ ছিল সীমিত, ফলে পাথর রক্ষা সম্ভব হয়নি।
গত মঙ্গলবার সরেজমিনে দেখা যায়, যেখানে একসময় পাথরের স্তূপ ছিল, এখন সেখানে গভীর গর্ত। পাথরের অভাবে পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। পরিবেশকর্মীরা বলছেন, এই লুটের মূল কারণ স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের মদদ। প্রথম আলোর অনুসন্ধানেও কয়েকজন নেতার নাম উঠে এসেছে, যাঁদের কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে গেছেন।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) সংগঠনের সিলেটের সদস্যসচিব আবদুল করিম চৌধুরীর অভিযোগ, প্রশাসন ইচ্ছা করলেই লুটপাট ঠেকাতে পারত, কিন্তু তা করেনি। তাঁর দাবি, বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা প্রকাশ্যে পাথর কোয়ারি চালুর পক্ষে বক্তব্য দিয়ে লুটপাটকে উৎসাহিত করেছেন।
সিলেটে মোট আটটি পাথর কোয়ারি আছে, এছাড়া জাফলং, বিছনাকান্দি, উৎমাছড়ার মতো পর্যটনকেন্দ্রেও পাথর পাওয়া যায়। ২০২০ সালের আগে পরিবেশের ক্ষতি এড়াতে সংরক্ষিত এলাকা বাদ দিয়ে এসব কোয়ারি ইজারা দেওয়া হতো, কিন্তু পরে ইজারা বন্ধ হয়ে যায়। তবুও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন চলতে থাকে, যা আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
দেশে নির্মাণ খাতে পাথরের বিপুল চাহিদা থাকায় আমদানি নির্ভরতা বেড়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৯৫ লাখ মেট্রিক টন পাথর বিদেশ থেকে আনা হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ১,৬০০ কোটি টাকা। স্থানীয়ভাবে সিলেটের পাথর প্রতি ঘনফুট ৬০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়। ধারণা করা হচ্ছে, সাদাপাথরে লুট হওয়া পাথরের মূল্য প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা, যদিও সুনির্দিষ্ট হিসাব নেই।
বিগত কয়েক বছরে সিলেটের ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতারা পাথর উত্তোলনের অনুমতি পেতে নানা প্রচেষ্টা চালালেও সরকার অনুমতি দেয়নি। গত ২৭ এপ্রিল অন্তর্বর্তী সরকার ১৭টি কোয়ারির ইজারা স্থগিত করে, যার মধ্যে সিলেটের আটটি অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সংরক্ষিত এলাকা ও পর্যটনকেন্দ্র থেকেও পাথর লুট থামানো যায়নি।
২৪ জুন সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে কোয়ারি ইজারার দাবিতে মানববন্ধনে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতারা অংশ নেন। পরিবেশকর্মীরা মনে করেন, এ ধরনের রাজনৈতিক অবস্থান লুটপাটে প্রভাব ফেলেছে। যদিও এসব নেতা দাবি করেছেন, তাঁরা লুটের পক্ষে নন এবং নীতিমালার ভিত্তিতে কোয়ারি চালুর পক্ষে ছিলেন।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সিলেটের কোয়ারিগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয় বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় নেতারা। অভিযোগ অনুযায়ী, তাঁদের মদদেই প্রকাশ্যে লুট শুরু হয়। প্রথমে জেলার অন্যান্য কোয়ারি থেকে পাথর লুট হয়ে গেলে নজর পড়ে সাদাপাথরে, যেখানে গত এপ্রিল থেকে লুটপাট শুরু হয় এবং শেষ এক মাসে তা চরম আকার নেয়।
অভিযোগ আছে, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন আত্মীয় সরাসরি লুটপাটে জড়িত। এ ঘটনায় বিএনপি তাঁর সব দলীয় পদ স্থগিত করেছে, তবে এখনো প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এস কে আর