
“মায়ের মতো আপন কেহ নাই রে, মায়ের মতো আপন কেহ নাই…” এ গানটিকে মিথ্যে প্রমাণ করে দেখালেন রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষিকা মেহরিন চৌধুরী।
নিজের দুই সন্তানের মুখ ভুলে তিনি আঁকড়ে ধরেছিলেন অন্যের সন্তানদের। বাঁচিয়েছেন অন্তত ২০ জন শিক্ষার্থীকে, তবে নিজেকে আর বাঁচাতে পারেননি।
২১ জুলাই, সোমবার দুপুর। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আকাশে হঠাৎ ভেঙে পড়ে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান। মুহূর্তেই আগুনে ছেয়ে যায় বিদ্যালয়ের একাংশ। আর সেখানেই সময়ের দৌড়ে এগিয়ে যান মেহরিন। ভেতর থেকে শিক্ষার্থীদের টেনে, ঠেলে, কোলে করে বাইরে বের করে আনেন। তাদের ভয় না পাওয়ার সাহস দেন। নিজের পায়ের নিচে আগুন, দেহে ছড়িয়ে পড়ছে পুড়ন্ত ধোঁয়া—তবু তাঁর কণ্ঠে শুধু ছিল সাহসের ভাষা।
এক সেনা কর্মকর্তা জানালেন, “ম্যাডাম নিজে ঢুকে গেছেন আগুনের ভেতর। বাচ্চাগুলারে একে একে বের করে দিলেন। কিন্তু উনি আর ফেরত আসতে পারেন নাই।”
চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী ছোয়া জানেই না, কে তাকে নতুন জীবনটা উপহার দিয়েছেন। তার বাবা সুমন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “ম্যাডাম না থাকলে ছোয়া বাঁচত না।”
৪৬ বছর বয়সী মেহরিন চৌধুরীকে ১০০ শতাংশ দগ্ধ অবস্থায় ভর্তি করা হয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। রাত সাড়ে সাতটার দিকে সেখানেই নিভে যায় তাঁর জীবন প্রদীপ। তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে বইতে থাকে ভালোবাসার বন্যা, অশ্রুর প্লাবন। দেশের প্রতিটি মায়ের মুখে এখন একটিই নাম—মেহরিন।
এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২৯ জন নিহতের পাশাপাশি শতাধিক দগ্ধের খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু এই নিঃসীম অন্ধকারের মধ্যেও আলো হয়ে আছেন মেহরিন। তাঁর আত্মত্যাগ নতুন করে আমাদের শেখায়—মানুষের প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ব আর সাহস কতটা বড় হতে পারে।
নিজ সন্তানদের মুখ আর কোনোদিন দেখবেন না মেহরিন। কিন্তু তিনি রেখে গেলেন অন্তত ২০টি পরিবারে হাসি, প্রাণ, ভবিষ্যৎ। এক মায়ের জায়গায় দাঁড়িয়ে যেন হয়ে উঠলেন শত মায়ের ভালোবাসার ছায়া। একজন শিক্ষিকার সাহস, ভালোবাসা ও আত্মত্যাগ—কোন পাঠ্যবইতেই তা শেখানো হয় না।