
ব্যাগ পুড়ে ছাই, বই পুড়ে ছাই। সেই ব্যাগে ছিল রঙিন খাতা, যেখানে লেখা হয়েছিল 'আমার প্রিয় ঋতু'। সেই বইয়ের পাতায় ছিল হাতের লেখা—আনন্দ, আগ্রহ আর আলোর হাতছানি। এখন সবই নিঃশেষ।
নতুন বই, জামা আর কেনা হবে না। স্কুল ডায়েরিতে আর লেখা হবে না ‘আজ আমি ভালো ছিলাম’। স্কুল ছুটি হলে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মা-বাবা আর কখনোই দেখতে পাবেন না তাদের প্রিয় মুখ।
হোমওয়ার্ক শেষ না করায় মা আর রাগ করবে না। বাবার কাছে আর কেউ বায়না ধরবে না বেড়াতে যাওয়ার জন্য। জুতা পরে প্রস্তুত হয়ে কেউ বলবে না, "চলো মা, দেরি হয়ে যাচ্ছে।"
সবই থেমে গেছে। সবই নিঃশব্দ।
যারা স্কুলে গিয়েছিল শিখতে, তারা ফিরল না। ফিরল পোড়া খাতা, ছেঁড়া ব্যাগ আর শূন্যতা।
উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এখন যেন এক মৃত্যুপুরী। এক সময় যেখানে ছিল শিশুকণ্ঠের কলরব, ক্লাসরুমে পাঠদান, করিডোরে কোলাহল—সেই জায়গায় এখন শুধু স্তব্ধতা। বাতাস ভারী পোড়া গন্ধে। সেই গন্ধ কি কেবল পোড়া কাঠের? না কি পোড়ানো স্বপ্নের, নিভে যাওয়া জীবনদীপের?
সোমবার দুপুরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয় স্কুলটির একটি ভবনে। আগুন ছড়িয়ে পড়ে মুহূর্তে। তখন চলছিল ক্লাস। শিশুরা ছিল শ্রেণিকক্ষে। কিছু বোঝার আগেই আগুন ঘিরে ফেলে ভবনটিকে। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় ভবনের একটি অংশ, আর সেই সাথে বহু শিশুর জীবন।
প্রাথমিক শাখার সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বই-খাতা-বালিশ-জুতা আর খালি পানির বোতল দেখে যে কেউ থেমে যাবে। অর্ধপোড়া একটি বাংলা ব্যাকরণের বইয়ের মলাটে লেখা—‘মাহিনুর’। পাশে একটি আঁকা ছবি, হয়তো সেটিই ছিল তার হোমওয়ার্ক।
সিঁড়ির ধারে পড়ে থাকা ছোট্ট একটি গোলাপি ব্যাগ দেখে একজন মা কান্নায় ভেঙে পড়েন—"এটা আমার মেয়ের ব্যাগ...। ও বলেছিল, আজ নতুন গল্প শোনাবে ক্লাসে।"
ঘটনার পূর্ব সময়ে তারা এখানে পড়ছিল। আজ তাদের নাম লেখা খাতাই পড়ে আছে, অথচ তারা নেই। স্কুল মানেই তো নিরাপত্তা, ভালোবাসা। সেই স্কুলই এখন মৃত্যু ফাঁদ হয়ে গেল!”
আজ মাইলস্টোন স্কুল আর স্কুল নয়। আজকের দিনে ওটি যেন কবরস্থান, যেখানে শুয়ে আছে শিশুদের স্বপ্ন, শৈশব, হাসি।
আকাশে এখনো ঘুরছে যুদ্ধবিমান। কিন্তু সেই আকাশে উড়ছে না কাগজের প্লেন। উড়ছে না শিশুদের রঙিন কল্পনা। সব মাটি ছুঁয়ে পড়ে আছে, সব পুড়ে হয়ে গেছে ছাই।