
অন্ধকার সমাধি, পাঁচ শতাব্দীর নীরবতা , আর সেই নীরবতার বুক চিরে লেখা এক ভয়াল সতর্কবার্তা—
“আমার কবরের শান্তি ভঙ্গ কোরো না। অন্যথায় তুমি পাবে আমার থেকেও ভয়ঙ্কর এক দখলদার।”
১৯৪১ সালের জুন মাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অগ্নিঝরা সময়। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিন দাঁড়িয়ে আছেন উজবেকিস্তানের সমরখন্দে, কুখ্যাত এক কবরের সামনে। যিনি নিজের শক্তিকে বিশ্বাস করেন। স্স্তালিন অবজ্ঞার হাসি হাসলেন আর আদেশ দিলেন—কবর খুলে দাও।
স্থানীয়রা অনুনয় করলেন—“এ কবর খুলবেন না।” এ কবর কোনো সাধারণ মানুষের নয়। এখানে শায়িত ইতিহাসের অন্যতম ভয়াল শাসক—তৈমুর লং, যাকে বিশ্ব জানে তামেরলিন নামে।
স্তালিন কুসংস্কার মানেন না। তার নির্দেশে খোলা হলো কফিন। কফিন খোলার মুহূর্তে বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো আতর আর গোলাপজলের ঘ্রাণ। স্থানীয়রা কেঁপে উঠলেন—তাদের বিশ্বাস, পাঁচ শতাব্দীর ঘুম ভেঙে যেন আবার মুক্তি পেল তৈমুরের অভিশাপ!
আর তার মাত্র দুই দিন পরেই, ২২ জুন ১৯৪১। বজ্রপাতের মতো নেমে এলো হিটলারের অভিযান—'অপারেশন বারবারোসা।'
সোভিয়েত সীমান্ত ভেঙে পড়লো, একের পর এক শহর দখল করলো নাৎসি সেনারা। বন্দি হলো কোটি মানুষ, চালালো নৃশংস হত্যাযজ্ঞ আর তাতেই নিহত হলো লক্ষ লক্ষ মানুষ।৩৩ লাখ মারা গেল অনাহারে। মনে হলো, তৈমুরের সতর্কবাণী যেন জীবন্ত হয়ে উঠলো আর তৈমুরের ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হলো—
“আমার থেকেও ভয়ঙ্কর এক দখলদার আসবে!”
কিন্তু কে ছিলো এই তৈমুর লং? কি তার আসল পরিচয়? যুবক বয়সে ডাকাত, পরে সেনাপতি। খুঁড়িয়ে হাঁটার কারণে নাম হয় ল্যাংড়া তৈমুর বা তৈমুর লং।
তার নৃশংসতার কাহিনি রক্তে লেখা—
১৩৯৮ সালে দিল্লি দখলে হত্যা, ১০ হাজার বন্দি। ১৪০১ সালে বাগদাদে ১২০টি টাওয়ার গড়ে তোলা হয় মানুষের খুলি দিয়ে—প্রতিটিতে ছিল ৯০ হাজার মাথা! শিশুদের পিষে হত্যা, মায়েদের সামনে দাঁড় করিয়ে মৃত্যুদণ্ড—নির্মমতায় অতুলনীয় ছিল সে। স্তালিন এসব জানতেন, তবুও বিশ্বাস করলেন না। তার বদৌলতে পৃথিবী দেখলো এক ভয়াল অধ্যায়।
অবশেষে, ১৯৪২ সালের নভেম্বরে স্তালিন নির্দেশ দিলেন তৈমুরকে পুনরায় কবরস্থ করতে। আতর আর গোলাপজলে আচ্ছাদিত করে আবার শোয়ানো হলো তাকে চিরনিদ্রায়। আশ্চর্যজনকভাবে সেখান থেকেই শুরু হলো সোভিয়েতের ঘুরে দাঁড়ানো।
স্টালিনগ্রাদের যুদ্ধ, কুর্স্ক, তারপর একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত হলো হিটলারের নাৎসি বাহিনী। তাহলে কি সত্যিই তৈমুরের কফিন খোলার সঙ্গে সঙ্গে জেগে উঠেছিল তার অভিশাপ? আর কবর পুনরায় বন্ধ করতেই কি থেমে গেল হিটলারের জয়যাত্রা?
ইতিহাস হয়তো উত্তর দেয় না। তবুও সমরখন্দের সেই কবরফলকে খোদাই করা কথাগুলো আজও শিহরণ জাগায়—
“যখন আমি মৃত্যু থেকে জেগে উঠবো, পৃথিবীটা আবারও কেঁপে উঠবে!”