জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে ডেভিড বার্গম্যানের প্রতিক্রিয়া
ছবিঃ সংগৃহীত

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে ব্রিটিশ মানবাধিকার কর্মী এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি বলেন, "আমি ২৭ পৃষ্ঠার জুলাই সনদের একটি অনানুষ্ঠানিক ইংরেজি সংস্করণ পড়েছি, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে।

এই সনদে নাকি তাদের ঐকমত্য প্রতিফলিত হওয়ার কথা। আমার কিছু পর্যবেক্ষণ:

১. এটি বেশ জটিল একটি নথি, পুরোপুরি বোঝার জন্য সময় লাগবে। তবে প্রথম পড়াতেই মনে হচ্ছে, অধিকাংশ প্রস্তাব যুক্তিসঙ্গত ও প্রগতিশীল সংস্কার হিসেবে গ্রহণযোগ্য। এগুলোর উদ্দেশ্য হলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও স্বাধীন করা এবং প্রধানমন্ত্রীর হাতে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা হ্রাস করা। সংবিধান সংস্কারে আগ্রহী বেশির ভাগ মানুষ এসব প্রস্তাবকে সমর্থন করবেন বলেই আমার ধারণা।

২. ‘রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি’ প্রসঙ্গে একটি সচেতন অস্পষ্টতা রাখা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বর্তমানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সেখানে অন্তর্ভুক্ত আছে, কিন্তু শব্দটি ইসলামি ডানপন্থীদের আক্রমণের মুখে, যারা বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

সনদের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রস্তাব করা হয়েছে—‘সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’কে মূলনীতিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আমার মনে হয়, এটি বিদ্যমান ধারাকে বাতিল করার প্রস্তাব নয়; বরং নতুন শব্দ যোগ করার কথা বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দ নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারের হাতে থেকে যাচ্ছে, যা ইতিবাচক।

৩. সংসদের দ্বিতীয় কক্ষ গঠনের উদ্দেশ্য সম্ভবত সরকারের ক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ তৈরি করা। তাত্ত্বিকভাবে এটি কার্যকর হতে পারে, তবে বাস্তবে কীভাবে দাঁড়াবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান কি সংসদ সদস্য সংখ্যা বাড়ানোতে রয়েছে—এই প্রশ্নও থেকেই যায়।

৪. সনদের শেষ অংশে এটিকে সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন দলিল হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে, এমনকি বর্তমান সংবিধানের চেয়েও বেশি। এটিকে ন্যায্যতা দেওয়ার জন্য যুক্তি দেওয়া হয়েছে যে: ক) রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, খ) গণতন্ত্রে জনগণের ইচ্ছা রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়, গ) যেহেতু জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রণীত, তাই এটি জনগণের ইচ্ছার সর্বোচ্চ প্রকাশ।

কিছু প্রস্তাব অবশ্যই ইতিবাচক এবং ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হতে পারে। তবে একে অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা উচিত নয়। এ ঐকমত্য এসেছে এমন কিছু রাজনৈতিক দল থেকে, যাদের অনেকই ছোট, অগণতান্ত্রিক চর্চায় অভ্যস্ত এবং ২০০৮ সালের পর কোনো অবাধ নির্বাচনে পরীক্ষিত হয়নি। সুতরাং তাদের সিদ্ধান্তকে জনগণের সর্বোচ্চ ইচ্ছার প্রতিফলন বলা হাস্যকর। সংবিধানের ঊর্ধ্বে এ সনদকে ভাবাটাও সম্পূর্ণ ভুল।

৫. সনদের প্রস্তাবনা অংশ জুলাই ঘোষণার তুলনায় অনেক বেশি সংযত ও নিরপেক্ষ। তবে মূল লেখায় কিছু বিষয় নিয়ে আমার আপত্তি আছে।

প্রথমত, নিহতের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ‘১ হাজার ৪০০ জনের বেশি’। কিন্তু সরকারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তালিকায় প্রায় ৮৫০ জনের নাম রয়েছে (প্রজ্ঞাপনে ৮৩৬ জন)। বাস্তবে সংখ্যাটি হয়তো ৯০০ থেকে ১ হাজারের মধ্যে। জাতিসংঘও ‘১ হাজার ৪০০ জনের বেশি’ বলেনি, বরং বলেছে ‘১ হাজার ৪০০ জন নিহত হয়ে থাকতে পারে’। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও আওয়ামী লীগের সমর্থকও রয়েছেন। জুলাই ঘোষণায় নিহতের সংখ্যা ‘প্রায় এক হাজার’ বলা হয়েছিল, যা অনেক বাস্তবসম্মত। সুতরাং সনদের ভাষা সেই সংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা উচিত। আহতের ক্ষেত্রেও সরকারি তথ্যনির্ভর পরিসংখ্যান ব্যবহার করা প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত, পটভূমি অংশে ২০০৯–২০২৪ সময়কালকে আওয়ামী লীগের দমননীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সময় হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, যেখানে ‘রাষ্ট্রীয় মদদে গুম, হত্যা, নির্যাতন, মামলা-মোকদ্দমা ও হামলা’ ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। এসবের বহু উদাহরণ বাস্তবেও আছে। কিন্তু সেখানে ২০০৯ সালের পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে যুক্ত করা হয়েছে, যা সমস্যাজনক।

কারণ, এ ঘটনায় সরকারের ‘ইচ্ছাকৃত ভূমিকা’ প্রমাণিত হয়নি। অনেকে অনুমান করেন আওয়ামী লীগ সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্ব ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করেছিল, কিন্তু তার কোনো প্রমাণ নেই। সর্বোচ্চ হলে এটি সরকারের অব্যবস্থাপনার দায় হতে পারে। সুতরাং এটি রাষ্ট্রীয় নৃশংসতার তালিকায় যুক্ত করা অনুচিত। অন্যান্য প্রমাণিত রাষ্ট্রীয় সহিংসতা সনদে যথেষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে—সেগুলোতেই ফোকাস করা উচিত।