ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি, করোনার ঝুঁকি এখনো বিদ্যমান
ছবিঃ সংগৃহীত

নারায়ণগঞ্জের আমেনা বেগম (৪৮) সাত দিন আগে তীব্র জ্বর ও শরীরের ব্যথায় ভুগছিলেন। ওষুধ সেবন করেও জ্বর কমছিল না। পরিক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। রক্তের প্লাটিলেট ৪০ হাজারে নেমে গেলে পরিবারের সদস্যরা তাঁকে ঢাকায় এনে ভর্তি করেন। ১ জুলাই থেকে আমেনা ঢাকার মহাখালীর উত্তর সিটি করপোরেশন পরিচালিত ডিএনসিসি কোভিড-১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি আছেন।

তার ছেলে অর্ণব মোহাম্মদ জানান, ভর্তি হওয়ার পরদিন তার মায়ের প্লাটিলেট কমে ১৮ হাজারে নেমে গিয়েছিল। গত চার দিন ধরে তিনি এবং তার বাবা হাসপাতালে থেকে তার মায়ের পরিচর্যা করছেন। রাতের বেলা তাঁরা হাসপাতালের বারান্দায় মাদুর পেতে ঘুমান।

আইসিইউতে আরও একজন রোগী, জান্নাতুল (১৭) ভর্তি আছেন। তার জন্য রক্ত সংগ্রহ চলছে। জান্নাতুলের মা জানালেন, ১০ জুন তিনি মেয়েকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়েছিলেন। ২৭ জুন সেখানে মেয়ের জ্বর বেড়ে গেলে জেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। অধিক ভিড়ের কারণে চিকিৎসকের পরামর্শে ৩০ জুন তিনি মেয়েকে ঢাকায় ডিএনসিসি হাসপাতালে ভর্তি করেন। মেয়ের প্লাটিলেট কমে ৬ হাজারে নেমে আসায় আরও রক্ত দিতে হবে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

ডিএনসিসি হাসপাতালের ইনচার্জ করপোরাল মো. মিয়ারুল ইসলাম জানালেন, আইসিইউতে শুক্রবার ১৫ জন রোগী ছিলেন, যাদের মধ্যে ৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত। হাসপাতালের ওয়ার্ডসহ মোট ভর্তি রোগীর সংখ্যা ১৩১। এর মধ্যে ডেঙ্গু রোগী ২৬, কোভিড রোগী ১৯ ও অন্যান্য রোগী ৮৬ জন। চিকুনগুনিয়া শনাক্তের আলাদা ব্যবস্থা না থাকলেও উপসর্গ থেকে ধারণা করা হচ্ছে কিছু রোগী আক্রান্ত।

রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় এখন জ্বর, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও করোনার প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, বর্তমানে ডেঙ্গু বেশি ছড়াচ্ছে এবং আগামী দুই মাসে এটি আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ৩ থেকে ৪ জুলাই ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ২০৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন, কারো মৃত্যু হয়নি। ঢাকায় সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে ৫৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৬ জন সর্বোচ্চ।

গত ২০ জুন ২৪ ঘণ্টায় দেশে ১৫১ জন এবং ঢাকার হাসপাতালে ২৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিল।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. টিটো মিঞা বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে হাসপাতালে ও ক্লিনিকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। পাশাপাশি করোনার রোগীর সংখ্যাও বেশি। তিনি সতর্ক করে বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। এখনই প্রয়োজনীয় সরকারি পদক্ষেপ ও জনসচেতনতা না বাড়ালে পরিস্থিতি মারাত্মক হবে।

তিনি বলেন, বাড়িতে জমে থাকা পানি—যেমন বাথরুমের কোনায়, টবে, টায়ারে—এডিস মশার প্রজননস্থল। সেজন্য জনসচেতনতা জরুরি। জ্বর হলে দ্রুত পরীক্ষা করাতে হবে। প্লাটিলেটের চেয়ে রক্তচাপ কমে গেলে তা গুরুতর সংকেত, তখন অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।

ঢাকা মহানগরের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ৩৫১ জন ভর্তি আছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ৫৭ জন ভর্তি হয়েছেন। বরিশাল বিভাগে গত ২৪ ঘণ্টায় ১০১ জন আক্রান্ত হয়েছে, যা সর্বোচ্চ। জানুয়ারি থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত দেশে মোট ১১,৬৬০ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বরিশালেই সর্বোচ্চ আক্রান্ত, মোট ৫,১৭০ জন। ৪৫ জনের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এলাকায় ২০ জন মারা গেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোলের লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক মো. হালিমুর রশিদ জানিয়েছেন, রোগীর সংখ্যা বাড়লে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তারা প্রস্তুত।

অনেকে বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। রামপুরার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক খালেদা আকন্দ (৫৬) গত সপ্তাহে প্রচণ্ড জ্বরে আক্রান্ত হন। প্রাথমিক চিকিৎসা মুঠোফোনে দেওয়া পরামর্শে চলছিল। তৃতীয় দিন পরীক্ষায় ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে, কিন্তু পরের দিন চোখ লাল হয়ে রক্ত পড়তে শুরু করলে আবার পরীক্ষা করানো হলে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। বর্তমানে খালেদার শারীরিক অবস্থা ধীরে ধীরে ভালো হচ্ছে।

ধানমন্ডির এক বাসায় ২২ বছর বয়সী হাফিজা বেগম গত ২৯ জুন জ্বর ও প্রচণ্ড গায়ে ব্যথায় আক্রান্ত হন। পরীক্ষায় ডেঙ্গু নেগেটিভ আসলেও চিকিৎসকরা চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ দেখে চিকিৎসা দিয়েছেন। বর্তমানে তিনি হাসপাতাল থেকে বাড়িতে ফিরে সুস্থ হচ্ছে।

মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড-১৯ হাসপাতালের আইসিইউতে কোভিড রোগীরাও রয়েছেন। একজন নারীর খালার কোভিড শনাক্ত হয়েছে, যিনি কিডনি রোগে ভুগছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ৩-৪ জুলাই ২৪ ঘণ্টায় ২৪২ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে, কোনো মৃত্যু হয়নি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার জানান, আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রকোপ ভয়াবহ হতে পারে। দেশের প্রতিটি জেলায় এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব বিপজ্জনক মাত্রায় রয়েছে। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার পর্যায়ে মশকনিধন কার্যক্রম দুর্বল ছিল, তাই ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়ছে, গ্রামাঞ্চলেও এর প্রকোপ বাড়ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞানভিত্তিক সমন্বিত মশক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দরকার। বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করে পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি।

তিনি আরও বলেন, আগামী দুই মাসে রোগীর সংখ্যা বাড়লে হাসপাতালগুলোতে যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকতে হবে, কারণ বর্তমানে হাসপাতালগুলো রোগী সামলানোর সক্ষমতা কম।