
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা ক্রমেই গভীরতর রূপ নিচ্ছে। ইরান এবার সরাসরি হুমকি দিয়েছে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক পথ হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেওয়ার। এই হুমকির ফলে বিশ্বজুড়ে তেলের বাজারে ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়েছে এবং অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা করছেন, এমন পদক্ষেপের ফলে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, হরমুজ প্রণালি বন্ধ হলে জ্বালানি তেলের দামে ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি দেখা যাবে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি, আল-জাজিরা ও রয়টার্স জানিয়েছে, ইরান ইতিমধ্যে তাদের সংসদে এই প্রণালি বন্ধের সিদ্ধান্ত পাস করেছে, যদিও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল।
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলমান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। এরই মধ্যে ইরানের তেল স্থাপনায় হামলার খবর ছড়ালে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম প্রতিদিনই কিছুটা করে বাড়ছে। বর্তমান মূল্য দাঁড়িয়েছে ব্যারেলপ্রতি ৬৯ ডলার, যা যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর দুই ডলার কমে এসেছে।
বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস সতর্ক করেছে, যদি হরমুজ প্রণালিতে এক মাসের জন্য তেল পরিবহন অর্ধেকে নেমে আসে এবং পরবর্তী ১১ মাসে ১০ শতাংশ হ্রাস পায়, তাহলে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ১১০ ডলারে পৌঁছাতে পারে। আর যদি ইরান দৈনিক ১৭.৫ লাখ ব্যারেল তেল কম রপ্তানি করে, তাহলে দাম ৯০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে। তবে ২০২৬ সালের মধ্যে সরবরাহ স্বাভাবিক হলে দাম ৬০–৭০ ডলারে নামতে পারে।
অন্যদিকে জে পি মরগ্যান জানিয়েছে, ইতিহাস বলছে—মধ্যপ্রাচ্যে সরকার পরিবর্তনের পর তেলের দাম গড়ে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে; কখনো ৭৬ শতাংশও।
এই সংকটের ছায়া পড়েছে শেয়ারবাজারেও। মার্কিন এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ও নাসডাক ফিউচারস যথাক্রমে ০.৫ ও ০.৬ শতাংশ কমেছে। এশিয়া ও ইউরোপের বাজারেও পতন নেমেছে ০.৫ থেকে ০.৯ শতাংশের মধ্যে।
মুদ্রাবাজারে ডলার কিছুটা শক্তিশালী হলেও সোনা ও মার্কিন ট্রেজারি বন্ডে চাহিদা বেড়েছে খুব সামান্যই। জাপানি ইয়েন ও ইউরোর বিপরীতে ডলারের মান বেড়েছে ০.৩ শতাংশ করে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানিয়েছে, তেলের দাম বাড়লে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ধাক্কা খেতে পারে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বলেন, “তেলের বাজারের প্রতিটি গতিবিধি আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। তেলের মূল্যবৃদ্ধি বিশ্বজুড়ে মন্দা সৃষ্টি করতে পারে।”
হরমুজ প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি ১০ লাখ ব্যারেল তেল পরিবাহিত হয়, যা বৈশ্বিক তেল বাণিজ্যের ২১ শতাংশ। পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলো—সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, এমনকি ইরান—এ পথেই তেল রপ্তানি করে। এর ৭০ শতাংশ যায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ায়—চীন, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ আরও কয়েকটি দেশে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হরমুজ প্রণালি পুরোপুরি বন্ধ করা ইরানের পক্ষে কঠিন। প্রণালির বড় অংশ ওমানের সীমানার মধ্যে এবং এটি এতটাই প্রশস্ত যে এককভাবে ইরান পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে পারবে না। তাছাড়া এর মাধ্যমে তেল রপ্তানি বন্ধ করা ইরানের নিজের অর্থনীতিতেও বড় আঘাত আনবে।
এলেন ওয়াল্ড, যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সভার্সাল কনসালটিংয়ের প্রেসিডেন্ট, বলেন, “ইরান যদি সত্যিই হরমুজ বন্ধ করে, তাহলে চীনসহ বড় ক্রেতারা বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানাবে। এটি ইরানের নিজের স্বার্থেও যাবে না।”
এই বাস্তবতা বুঝেই যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনের সহায়তা চাচ্ছে, যাতে তারা ইরানকে বোঝায় হরমুজ প্রণালি বন্ধ না করতে।