বিদেশি আমানতের জোয়ার: এক বছরে ডলারে জমা দ্বিগুণ
ছবিঃ সংগৃহীত

গত এক বছরে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবে এবং সাধারণ বিদেশি মুদ্রা ভিত্তিক আমানতের পরিমাণ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশিরাও আগের তুলনায় বেশি পরিমাণে বিদেশি মুদ্রা নিজেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা রাখছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এসব আমানত প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

অন্যদিকে দেশি মুদ্রায় সাধারণ ব্যাংক আমানতের প্রবৃদ্ধি একই সময়ে মাত্র ১ দশমিক ০৯ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক পরিবর্তন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত সুবিধাজনক নীতির কারণে মানুষ আবার ব্যাংক ব্যবস্থায় আস্থা ফিরে পাচ্ছেন।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও নীতিগত উদ্দীপনা

২০২৩ সালের আগস্টে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকারের পরিবর্তনের পর থেকে সাধারণ মানুষ ঘরে থাকা ডলার বা বিদেশি মুদ্রা আবার ব্যাংকে জমা রাখা শুরু করেছে। বিশেষ করে রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট (RFCD) হিসাব ও ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্টে (FCA) সুদসহ বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ায় এই প্রবণতা বাড়ছে। এতে একদিকে যেমন ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিও শক্তিশালী হচ্ছে।

কোন হিসাব কতটা বেড়েছে

বাংলাদেশে বসবাসরত বিদেশিদের টাকায় রূপান্তরযোগ্য হিসাব (কনভার্টেবল টাকা অ্যাকাউন্ট) গত মার্চে দাঁড়িয়েছে ৩,৮৫৯ কোটি টাকায়, যা এক বছর আগে ছিল মাত্র ১,৮০৪ কোটি টাকা। একইভাবে এফসিএ হিসাবেও জমা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪,৭৫০ কোটি টাকায়, যেখানে আগের বছর ছিল ৬,০৫৪ কোটি টাকার সমপরিমাণ।

প্রবাসীদের জন্য বিশেষভাবে তৈরি আমানত হিসাবগুলোতেও কিছুটা প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে—২০২৩ সালের মার্চে এই হিসাবগুলোয় স্থিতি ছিল ৩,৪৭৭ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের মার্চে দাঁড়িয়েছে ৪,৭৭৮ কোটিতে।

RFCD হিসাবেও উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। বিদেশ সফর শেষে দেশে ফেরা বাংলাদেশিদের এই হিসাবগুলোতে আমানতের পরিমাণ এক বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩,২৭৩ কোটি টাকায়, যা আগের বছর ছিল ২৬,১৩০ কোটি টাকা।

ব্যাংক খাতে সার্বিক আমানতের চিত্র

যদিও বৈদেশিক মুদ্রার ভিত্তিতে ব্যাংকে জমা বাড়লেও সার্বিক ব্যাংক খাতে আমানতের প্রবৃদ্ধি তেমন হয়নি। ২০২৪ সালের মার্চে মোট ব্যাংক আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা, যেখানে ২০২৩ সালের একই সময়ে ছিল ১৭ লাখ ৬২ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা—অর্থাৎ মাত্র ১ শতাংশের একটু বেশি বৃদ্ধি।

ডলার জমার কারণ ও সুবিধা

ডলার–সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে নতুন সুবিধা চালু করে—RFCD অ্যাকাউন্টে সুদ, সহজ উত্তোলন ও আন্তর্জাতিক খরচের সুযোগ। এতে গ্রাহকরা উৎসাহিত হয়ে আবার ব্যাংকে ডলার রাখতে শুরু করেন।

এই ধরনের হিসাবগুলোতে জমা ডলারের ওপর সুদ পাওয়ার পাশাপাশি বিদেশ ভ্রমণে ৫,০০০ ডলার পর্যন্ত নগদ উত্তোলন করা যায় এবং শিক্ষা, চিকিৎসা বা অন্যান্য প্রয়োজনেও বিদেশে খরচ করা যায় কোনো সীমা ছাড়াই।

ব্যাংকের প্রতিযোগিতা ও আন্তর্জাতিক আস্থা

বর্তমানে ইস্টার্ন ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক, ডাচ্-বাংলা, প্রাইম, পূবালী, এইচএসবিসি ও ইসলামী ব্যাংকসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এই হিসাবগুলোতে প্রতিযোগিতামূলক সুদের হার ও সেবা দিচ্ছে। এমনকি প্রবাসীরা এখন যেকোনো বৈদেশিক মুদ্রায় অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন, যা আগে শুধু ডলার, ইউরো, পাউন্ড ও ইয়েনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অভ্যন্তরীণ সংস্কার এবং চীনের মতো দেশের বিনিয়োগ আগমনের কারণে বিদেশিদের আস্থা বাড়ছে, যার ফলেই ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা জমার প্রবণতা জোরদার হয়েছে।

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, “বর্তমানে ব্যাংকে ডলার জমা রাখলে শুধু সুদ নয়, বহুমুখী সুবিধাও পাওয়া যাচ্ছে। এই প্রবণতা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক, বিশেষ করে তখন যখন দেশীয় মুদ্রায় আমানতের প্রবৃদ্ধি স্থবির।”