
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে দুই কিস্তিতে মোট ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার, যা গত ২২ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী বর্তমানে এই রিজার্ভ ২২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। এর বাইরে ব্যয়যোগ্য রিজার্ভ রয়েছে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলারের মতো, যা দিয়ে তিন মাসের বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
মঙ্গলবার (২৫ জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান গণমাধ্যমকে এই তথ্য নিশ্চিত করেন। তার আগের দিন অর্থাৎ সোমবার রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আইএমএফ বোর্ড সভায় ঋণের তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তি একসঙ্গে ছাড়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চলমান ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে তিন কিস্তিতে ২৩১ কোটি ডলার পেয়েছে। বাকি ২৩৯ কোটি ডলারের মধ্যে দুই কিস্তি অনুমোদনের পর আর মাত্র ১২৯ কোটি ডলার পাওনা রয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মাসের শুরুতে দেশের গ্রোস রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার এবং বিপিএম-৬ অনুসারে ২০ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার। ১৫ জুন পর্যন্ত গ্রোস রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন এবং বিপিএম-৬ হিসেবে ২০ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। ২৩ জুন পর্যন্ত রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ৮২ বিলিয়ন (গ্রোস) এবং ২১ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন (বিপিএম-৬) ডলার। এর পরের দিন অর্থাৎ ২৪ জুন অর্থ ছাড়ের পর তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৭ দশমিক ৩১ বিলিয়ন এবং বিপিএম-৬ হিসেবে ২২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
২০১৩ সালের জুন মাসে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। পরবর্তী কয়েক বছরে তা ধাপে ধাপে বাড়তে থাকে। ২০১৮ সালে রিজার্ভ দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারে এবং ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে তা পৌঁছায় ৩৯ বিলিয়ন ডলারে। এরপর অক্টোবর মাসে তা প্রথমবারের মতো ৪০ বিলিয়নের মাইলফলক ছাড়িয়ে যায় এবং ২০২১ সালের আগস্টে রেকর্ড ৪৮ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়।
তবে ২০২২ সালের পর থেকে বৈদেশিক চাপে, ডলার সংকট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা সংকটের কারণে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ন্যূনতম তিন মাসের আমদানি ব্যয় সমপরিমাণ রিজার্ভ থাকা অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশ বর্তমানে সেই সীমার কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে, যা একদিকে সতর্কবার্তা হলেও সাম্প্রতিক উত্থান কিছুটা স্বস্তির বার্তা বহন করে।
বিগত সরকার আমলে রিজার্ভ ব্যয়যোগ্য হিসাবে ১৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। সে সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ডলার কিনে রিজার্ভ টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। তবে ২০২৪ সালের আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ ব্যবহারের নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হয়। নতুন গভর্নরের অধীনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ রাখে এবং বিভিন্ন উৎস থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের উদ্যোগ নেয়। এর ফলে রিজার্ভে আবার ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা যায়।
আইএমএফের এই ঋণ সহায়তা শুধুমাত্র সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য নয়, বরং জলবায়ু সহনশীলতা, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি এবং ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষার উদ্দেশ্যেও ব্যবহৃত হবে। উল্লেখযোগ্যভাবে, আইএমএফের নতুন রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) তহবিল থেকে বাংলাদেশই এশিয়ায় প্রথম দেশ হিসেবে ঋণ পেয়েছে। সব মিলিয়ে সাম্প্রতিক ঋণ ছাড় ও রেমিট্যান্স প্রবাহে উত্থান বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতিতে একটি আশাব্যঞ্জক মোড় সৃষ্টি করেছে।