শিক্ষার পথে সন্তানেরা: স্কুলে ফিরছে নতুন প্রজন্ম
ছবিঃ সংগৃহীত

বন্যা এলে আতঙ্কে থাকেন কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার বন্দবেড় ইউনিয়নের শারমিন আক্তার। বন্যায় বারবার ফসল ডুবে যায়। আবার পরের বছর নতুন আশায় বুক বাঁধেন।

ভালো ফসল হলে তা বেচে ভালো করে ঘর তৈরি করবেন আর ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করাবেন; কিন্তু গত বছরেও আবাদের পেঁয়াজ আকাল বন্যায় নষ্ট হয়ে যায় শারমিনের। তবে এবার আর সেভাবে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি তাঁকে। নিজের ২১ শতাংশ জমির ফসল বিমা করিয়েছিলেন। এর সুফলও পেয়েছেন তিনি। শারমিন আক্তার বলেন, ‘মানুষের জীবনের বিমা হয় এত দিন শুনে এসেছি; কিন্তু ফসলের বিমা হয় এলাকার বড় ভাইদের মুখে শুনেছি। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে বিমা করেছিলাম। গত বছর ২১ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজের আবাদ আকাল বন্যায় নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিমা দাবির নগদ ৮ হাজার টাকা বুঝে পেয়েছি। ছেলেকে স্কুলে পড়ানোর স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্ন পূরণ করেছি। এবার সেই টাকায় ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। এ বছর ২১ শতাংশ জমিতে আমন ধান রোপণ করেছি। ফসল বিমার আওতায় সারা দেশের কৃষকদের আনা উচিত।’

মেঘনা খাতুন। চিলমারী উপজেলার অষ্টমিরচর ইউনিয়নের বাসিন্দা। তিস্তা নদীর ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়েছেন। এরপর আশ্রয় মিলেছে অষ্টমির চরে। উদয়-অস্ত পরিশ্রম করে চরে ফলাচ্ছিলেন সোনার ফসল; কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্বিপাকে প্রতিবছরই নষ্ট হচ্ছিল ধান, পাট কিংবা ভুট্টা। তাই হাড়ভাঙা খাটুনির পরও আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছিল না। অকাল বন্যা কিংবা তীব্র খরায় প্রতিবছরই আবাদের একটি অংশ নষ্ট হচ্ছিল। অনেকটা পেটেভাতে করে দিন পার করছিল মেঘনার পরিবার; কিন্তু গ্রামের নারীদের নিয়ে ‘যুগনিধি মহিলা জলবায়ু ও জীবিকা উন্নয়ন সমিতি’ গঠনের মাধ্যমে ফসল বিমার ব্যবস্থা নিজ গ্রামে চালু করেছেন নারীরাই। এর ফলে ঝুঁকি নিয়েও সারা বছর ফসল চাষ করছেন চরবাসী। এতে করে ফসল উৎপাদনে আর্থিক ঝুঁকি কমেছে। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থারও উন্নতি হচ্ছে।

সম্প্রতি কথা হয় মেঘনা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘চর অঞ্চলে সারা বছরই আবাদ হয়। বিভিন্ন ধরনের সবজির পাশাপাশি পেঁয়াজ, রসুন ও মরিচের আবাদ আমরা নিয়মিত করে থাকি। ফলে সমতলের ধান, পাট ও ভুট্টার আবাদের সঙ্গে চরের চাষ সময়ের কিছুটা হেরফের রয়েছে। তাই চরে ধান ও ভুট্টার আবাদ কিছুটা অনিশ্চিত। যেমন দুই বছর আগে ১৫ একর জমিতে ভুট্টা কিছুটা আগাম সময়ে রোপণ করেছি; কিন্তু তীব্র খরায় প্রায় আট একর উঁচু জমির ভুট্টার আবাদ নষ্ট হয়। এর ফলে প্রায় এক লাখ টাকার মতো আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এবার স্থানীয়ভাবে সমিতির মাধ্যমে আমরা নিজেরাই ফসল বিমা চালু করেছি। নিশ্চিন্তে এ বছর ১৫ একর জমিতেই ভুট্টা চাষ করেছি।’

শারমিন আক্তার ও মেঘনা খাতুনের মতো আরও অনেককে সহায়তা করেছে জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনসিডিএফ) এবং ইউএনডিপির লোকাল গভর্নমেন্ট ইনিশিয়েটিভ অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (লজিক) প্রকল্প। এখান থেকেই কৃষিবিমা ও এর সুবিধা সম্পর্কে জানানো হয়। ওইসব এলাকায় এ সুবিধা পেয়েছেন আরও ১৮ জন। দেশের আরও বেশ কিছু স্থানে এ ধরনের কার্যক্রম আছে লজিকের। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের অধীন পরিচালিত লজিক প্রকল্প বাংলাদেশ সরকার, সুইডেন, ডেনমার্ক, ইউএনসিডিএফ ও ইউএনডিপির একটি যৌথ প্রয়াস।

সরকারি সূত্রে জানা গেছে ২০১৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্র বিমা সম্মেলনে কৃষিবিমা চালুর উদ্যোগের কথা প্রথম জানায় বাংলাদেশ সরকার। পরের বছর ২০২০ সালে বাংলাদেশ সরকার কৃষিবিমা চালু করে। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখে সরকারি প্রতিষ্ঠান সাধারণ বিমা করপোরেশন। রাষ্ট্রীয় বিমা সংস্থাটি প্রাথমিকভাবে রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, নোয়াখালী ও কিশোরগঞ্জের মিঠামইন হাওরে পরীক্ষামূলকভাবে কৃষিবিমা চালু করে। পরবর্তী সময়ে সরকারের সঙ্গে কৃষিবিমা চালু করতে আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে সহযোগিতা করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অক্সফাম বাংলাদেশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে শস্যবিমা জনপ্রিয় করার বিকল্প নেই। বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বল্পপ্রযুক্তি, দুর্বল সরবরাহব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে। কৃষকের বিমা দাবিপ্রাপ্তি–সংক্রান্ত উদ্বেগও দূর করতে হবে। জাতীয় কৃষিনীতিতে কৃষিবিমা–সংক্রান্ত একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় সংযোজন করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশে সব ধরনের ফসলের উৎপাদন ছাড়িয়েছে প্রায় ১০ কোটি টন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, লবণাক্ততা, শৈত্যপ্রবাহ, পোকামাকড়ের আক্রমণে কৃষক বড় ধরনের ক্ষতির কবলে পড়েন। কৃষকদের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শস্যবিমা বা কৃষিবিমা–সহায়ক শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারে।

সরকারি তথ্যমতে বন্যা, ঝড় ও তাপপ্রবাহের ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৩০০ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। প্রাকৃতিক বিভিন্ন দুর্যোগের ফলে হওয়া এই ক্ষতির প্রায় পুরোটাই বহন করতে হচ্ছে কৃষককে। ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে কৃষকদের জন্য যে সুরক্ষা বলয় থাকা দরকার, তা নেই। ফলে অনেকেই আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষির প্রতি। এমন পরিস্থিতিতে দেশে ব্যাপকভাবে শস্য বা কৃষিবিমা চালু করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

প্রতিবেশী দেশ ভারতে অনেক বছর ধরে চালু আছে কৃষিবিমা। ভারতের গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, দেশটির ২৯ কোটি কৃষক এখন শস্যবিমার আওতায়। এ ছাড়া প্রতিবছর সাড়ে পাঁচ কোটি কৃষক নতুন করে এই বিমার আওতায় আসছেন। প্রতি পাঁচ বছরে ভারত সরকার প্রায় ৯০ হাজার কোটি রুপি বিমা দাবি পরিশোধ করেছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ খান বলেন, কৃষকদের কৃষি প্রচেষ্টাকে অপ্রত্যাশিত ঝুঁকি থেকে রক্ষা করার জন্য কৃষিবিমা ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে উঠেছে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ সরকারি সহযোগিতা প্রয়োজন। সরকারি উদ্যোগে এবং খরচে কৃষিবিমা স্কিম চালু করার মধ্য দিয়ে সরকার শুরুটা করতে পারে, যেখানে কৃষকদের জন্য ভর্তুকিযুক্ত বিমার সুযোগ প্রদান করবে। যার অধীন কৃষক বিভিন্ন শস্য, হাঁস-মুরগি, পশু ও মৎস্য সম্পদসহ বিভিন্ন ঝুঁকি কাভার করতে সক্ষম হবেন।

ফরিদ খান আরও বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি মজবুত করতে কৃষির অবদান অনস্বীকার্য। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এবং যুগোপযোগী দিকনির্দেশনায় একটি স্থায়ী এবং টেকসই শস্যবিমা ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়ন কৃষিতে দুর্দিন দূর করতে এবং কৃষকের সুদিন ফেরাতে অবদান রাখবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি মোকাবিলায় বিনা মূল্যে কিংবা ভর্তুকিযুক্ত কৃষি তথা শস্যবিমা চালু করা এখন সময়ের দাবি। মনে রাখা প্রয়োজন আজকের ঝুঁকিমুক্ত কৃষি, আগামীর সুরক্ষিত বাংলাদেশ।