চীনের অনুদানে বাংলাদেশে আসছে ২০টি নতুন মিটারগেজ ইঞ্জিন
ছবিঃ বিপ্লবী বার্তা

চীন থেকে ২০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি মূল্যের এসব ইঞ্জিন পুরোপুরি অনুদান বা বিনা পয়সায় দেবে চীন। এ লক্ষ্যে একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। আগামী দুই বছরের মধ্যে চীনের অনুদানের ইঞ্জিন পাওয়ার প্রত্যাশা করছে রেলওয়ে।


রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে রেলে মিটারগেজ ইঞ্জিনের সংকট প্রকট। ইঞ্জিনের অভাবে প্রায় প্রতিদিনই যাত্রী ও মালবাহী ট্রেনের চলাচল বাতিল করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন ইঞ্জিন কিনতে দরপত্র প্রক্রিয়াসহ নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগে। কিন্তু অনুদানের ক্ষেত্রে দরপত্র প্রক্রিয়া লাগে না, ফলে এক থেকে দেড় বছরের মধ্যেই নতুন ইঞ্জিন পাওয়া সম্ভব হবে।


এর আগে ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ভারত কয়েক দফায় ৩০টি ব্রডগেজ পুরোনো ইঞ্জিন বিনা পয়সায় বাংলাদেশকে দিয়েছে। ভারত এখন দ্রুত বিদ্যুৎচালিত ট্রেনে রূপান্তরিত হচ্ছে, ফলে তাদের অনেক ডিজেলচালিত ইঞ্জিন অব্যবহৃত রয়ে গেছে। বাংলাদেশসহ আরও কিছু দেশে এসব ইঞ্জিন অনুদান হিসেবে দিয়েছে ভারত।


বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ইঞ্জিন রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, কোরিয়া, ভারতসহ নয়টি দেশের। চীন থেকে এখনো কোনো ইঞ্জিন আমদানি হয়নি। তবে দেশটি থেকে কয়েক দফায় কোচ আমদানি করা হয়েছে। চীনের অনুদানের ইঞ্জিন এলে রেলের ইঞ্জিন নির্মাতা হিসেবে চীনের নামও যুক্ত হবে।


রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, গত মার্চে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের সময় বাংলাদেশ রেলওয়ের ইঞ্জিন ও কোচ সংগ্রহের বিষয়টি আলোচনায় আসে। তখন চীন ২০টি মিটারগেজ ইঞ্জিন অনুদান হিসেবে দেওয়ার আগ্রহ জানায়। পরে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা দূতাবাস আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) অনুদানের বিষয়ে জানায়। ইআরডি পরে রেলওয়েকে প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব (পিডিপিপি) তৈরির অনুরোধ জানায়।


গত ২৪ সেপ্টেম্বর পিডিপিপি পরিকল্পনা নীতিগত অনুমোদন দেন উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। এরপর তা ইআরডিতে পাঠানো হয়। এখন চীনা সরকারের সঙ্গে কারিগরি ও আনুষঙ্গিক আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবে ইআরডি। সবশেষে চুক্তি সই হবে। প্রকল্পটির সম্ভাব্য সময়সীমা ধরা হয়েছে আগামী জানুয়ারি থেকে ২০২৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।


রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, ২০টি ইঞ্জিন কেনার জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইঞ্জিন, পাঁচ বছর ব্যবহারের খুচরা যন্ত্রাংশ এবং পাঁচ বছরের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ অন্তর্ভুক্ত। চীন সরকার ব্যয় করবে ১ হাজার ৫৯১ কোটি টাকা, অর্থাৎ ইঞ্জিন, যন্ত্রাংশ ও রক্ষণাবেক্ষণের পুরো খরচ তারা বহন করবে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ৪৪ কোটি টাকার মতো ব্যয় করার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা মূলত শুল্ক ও কর বাবদ ব্যয় হবে।


রেলের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনুদানের ক্ষেত্রে সাধারণত পণ্য জাহাজে করে বাংলাদেশের বন্দরে পৌঁছে দেওয়া হয়। এরপর শুল্ক ও কর দিয়ে খালাস করতে হয় রেল কর্তৃপক্ষকে। শুল্ক ও কর অনুদানকারী দেশ বহন করে না। এর আগে ভারত থেকে পাওয়া পুরোনো ইঞ্জিনগুলোর ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ শুল্ক ও কর পরিশোধ করেছে।


রেলওয়ে সূত্র বলছে, চীন দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে রেল ইঞ্জিন বিক্রির আগ্রহ প্রকাশ করে আসছে। তবে বাংলাদেশ এত দিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশের ইঞ্জিনের ওপর বেশি নির্ভর করেছে। এর আগে চীন থেকে আনা রেল কোচ দিয়ে ভালো সেবা পাওয়া গেছে, যা এবার ইঞ্জিনেও ইতিবাচক অভিজ্ঞতা এনে দেবে বলে মনে করছে রেলওয়ে।


রেলের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন বলেছেন, “রেলে বর্তমানে ইঞ্জিনের সংকট আছে। বিশেষ করে মিটারগেজ ইঞ্জিনের সংকট বেশি। এ পরিস্থিতিতে চীনের অনুদান হিসেবে ইঞ্জিন পেলে রেলওয়ের অনেক উপকার হবে।”


রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রেলে এখন মিটারগেজ ইঞ্জিনের সংকট সবচেয়ে বেশি। ঢাকাসহ চট্টগ্রাম, সিলেটে মিটারগেজ ট্রেন চলাচল করে। এছাড়া উত্তরবঙ্গের বগুড়া, নাটোর, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, পঞ্চগড়সহ আরও কিছু জেলায়ও মিটারগেজ ট্রেন চলে। অন্যদিকে খুলনা ও রাজশাহী অঞ্চলে চলে ব্রডগেজ ট্রেন।


ইঞ্জিনের অভাবে প্রতিদিনই একাধিক যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন বাতিল হচ্ছে। গত জুন মাসে শুধু রেলের পূর্বাঞ্চলে লোকাল, মেইল, কমিউটার ও মালবাহী মিলে ৪৩৫টি ট্রেন বাতিল করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনালে এক হাজারের বেশি কনটেইনার পড়ে আছে, যেগুলো ইঞ্জিনের অভাবে পরিবহন করা যাচ্ছে না।


রেলওয়ে সূত্রের আশঙ্কা, এভাবে চলতে থাকলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আন্তনগর ট্রেনের যাত্রাও বাতিল করতে হবে। এতে রেলের আয় কমবে এবং যাত্রীদের ভোগান্তি আরও বাড়বে।