ইরান–ইসরায়েল সংঘাত: বিশ্ব অর্থনীতির জন্য নতুন বিপর্যয়?
ছবিঃ বিপ্লবী বার্তা

ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে টানা পাঁচ দিনের প্রাণঘাতী হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা তীব্রতর হচ্ছে। আশঙ্কা বাড়ছে যে সংঘাতটি সীমান্ত পেরিয়ে অঞ্চলের অন্য দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই অঞ্চল বিশ্বের প্রধান তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী এলাকাগুলোর একটি হওয়ায় বৈশ্বিক বাজারে প্রভাব ফেলার আশঙ্কা বাড়ছে।

২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানিতে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে যায়। এর ফলে মূল্যস্ফীতি তীব্র হয়। এখন আবার তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হলে একই ধরনের সংকট ফিরে আসতে পারে।

তেল হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতির চালিকা শক্তি। এর দাম বাড়লে উৎপাদন ব্যয় বাড়ে, যার প্রভাব সরাসরি ভোক্তার উপর পড়ে। বিশেষ করে খাদ্য, পোশাক ও রাসায়নিক পণ্যে এই চাপ বেশি পড়ে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে তেল আমদানিকারক দেশগুলো উচ্চ মূল্যস্ফীতির মুখে পড়তে পারে এবং প্রবৃদ্ধির হার কমে যেতে পারে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই পরিস্থিতি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর স্বাধীনতাকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে। জি-৭ দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বর্তমানে সুদহার কমানোর পরিকল্পনা করছে। কিন্তু যুদ্ধের কারণে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে গেলে এই পরিকল্পনা স্থগিত হয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে ইসরায়েলের হামলার পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে এবং ব্যারেলপ্রতি মূল্য ১০০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছানোর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিমধ্যে নীতিগত সুদের হার ৪.২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো সুদের হার কমানোর বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে আছে। যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও জটিল হলে ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার কমাবে না।

উচ্চ সুদের হার ও তেলের দামের ঊর্ধ্বগতি গত কয়েক বছরে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে ইতিমধ্যেই বাধাগ্রস্ত করেছে। এই নতুন সংকট পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলতে পারে।

বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ তেল পরিবহন রুট হলো হরমুজ প্রণালি, যা ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের মাঝে অবস্থিত। এই প্রণালি প্রতিদিন ১৮-১৯ মিলিয়ন ব্যারেল তেল পরিবহন করে, যা বৈশ্বিক ব্যবহারের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। ইরান বহুবার এই পথ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। যদি বাস্তবে তা ঘটে, তাহলে বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট তীব্র হবে।

সংঘাত দীর্ঘ হলে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলেও ব্যাঘাত ঘটবে। হুতি বিদ্রোহীরা ২০২৩ সালে লোহিত সাগরে জাহাজে হামলা শুরু করে, যার ফলে পরিবহন ব্যয় ও সময় উভয়ই বেড়ে যায়। এখনকার উত্তেজনার ফলে বড় বড় শিপিং কোম্পানিগুলো নিরাপদ বিকল্প রুট নিতে বাধ্য হতে পারে, যা খরচ আরও বাড়াবে। এমনকি কিছু কোম্পানি নিরাপত্তা ফি আরোপ করতে পারে।

রয়টার্স জানায়, গ্রিস ও যুক্তরাজ্য ইতিমধ্যেই বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে হরমুজ পারাপারের প্রতিটি ভ্রমণের তথ্য নথিভুক্ত করতে বলেছে। এ ছাড়া গ্যাস রপ্তানি বন্ধ হলে ইউরোপ ও এশিয়ায় জ্বালানি সংকট আরও তীব্র হতে পারে।

বিমান চলাচলও এই সংঘাতের ফলে ব্যাহত হচ্ছে। ইসরায়েল ও ইরান নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে এবং ইরাক ও জর্ডান একই পদক্ষেপ নিয়েছে। কিছু এয়ারলাইন ওই রুটে ফ্লাইট বাতিল করেছে। যুদ্ধের ঝুঁকিতে বিমান চলাচল কমে যাবে এবং বিকল্প রুটে যেতে বাড়তি খরচ হবে। ফলে বিমানভাড়াও বাড়তে পারে।

শুক্রবার ইসরায়েল 'বিশেষ জরুরি অবস্থা' ঘোষণা করলে দেশটির মুদ্রা শেকেল প্রায় ২ শতাংশ দরপতনের মুখে পড়ে। আতঙ্কে জনগণ বাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়ে, ফলে অনেক দোকানে পণ্য সংকট দেখা দেয়।

শেয়ারবাজারেও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। বিনিয়োগকারীরা সোনা ও ডলারের মতো নিরাপদ সম্পদের দিকে ঝুঁকছেন, যার ফলে সোনার দাম বাড়ছে এবং ডলারের মান শক্তিশালী হচ্ছে।

এই সংঘাত এমন সময় ঘটছে, যখন বিশ্ববাজার নানা অনিশ্চয়তায় জর্জরিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য শুল্ক নীতির কারণে বিশ্ববাণিজ্যে আস্থার ঘাটতি তৈরি হয়েছে। এর ফলে ভোক্তা ব্যয় কমে যাচ্ছে এবং ব্যবসার খরচ বাড়ছে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতির গতি আরও কমিয়ে দিতে পারে।