পথে পথে প্রার্থনা, গন্তব্য মক্কা: ঘোড়ার পিঠে হজযাত্রা
ছবিঃ বিপ্লবী বার্তা

স্পেনের তিন মুসলিম নাগরিক ঘোড়ায় চড়ে দীর্ঘ সাত মাসের কঠিন ও চ্যালেঞ্জপূর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে সৌদি আরবে পৌঁছে হজ পালন করেছেন। তাদের এই ব্যতিক্রমী হজযাত্রা কেবল দৈহিক শ্রমেরই নয়, বরং এক গভীর আত্মিক ও ঐতিহাসিক বন্ধনেরও প্রতিফলন।

এই যাত্রার মূল আয়োজক আবদুল্লাহ রাফায়েল হারনান্দেজ, যিনি ১৯৮৯ সালে স্পেনের একটি সরকারি হাইস্কুলে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতির সময় ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকে কুরআন অধ্যয়ন শুরু করেন। কুরআনের আয়াত, বিশেষ করে ভৌগোলিক বর্ণনা, তাঁকে মুগ্ধ করে। তখনই তিনি দুটি প্রতিজ্ঞা করেন—একটি, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ইসলাম গ্রহণ করবেন; অন্যটি, ঘোড়ায় চড়ে মক্কায় গিয়ে হজ পালন করবেন, যেমনটা অতীতে আন্দালুসিয়ান মুসলিমরা করতেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন ও নাম পরিবর্তন করে আবদুল্লাহ রাখেন।

৩৫ বছর পর, ২০২3 সালের অক্টোবরে অবসর গ্রহণের পর তিনি দ্বিতীয় প্রতিজ্ঞাটি পূরণে উদ্যোগী হন। তাঁর সঙ্গে যাত্রায় অংশ নেন দুই সফরসঙ্গী—আবদেলকাদের হারকাসি ও তারেক রদ্রিগেজ।

স্পেনের হুয়েলভা প্রদেশ থেকে যাত্রা শুরু হয়। পথে বহু প্রতিকূলতা আসে। স্পেন ছাড়ার আগেই খাবার, ঘোড়ার খাদ্য ও অর্থ শেষ হয়ে যায়। তখন নাভার এলাকার একটি গ্রামে মরক্কোর কিছু মুসলিম শ্রমিক তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন এবং প্রায় ১,২০০ ইউরো দেন।

ফ্রান্স ও ইতালির মাঝামাঝি আল্পস পার হওয়ার সময় সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতি আসে—তীব্র ঠান্ডা ও তুষারপাতে তাঁরা বিপদে পড়েন। কিন্তু ভাগ্য তাঁদের আরও এক নতুন দিক দেয়: ইতালির ভেরোনায় সৌদি ইনফ্লুয়েন্সার আবদেল রহমান আল-মুতিরির সঙ্গে দেখা হয়। তিনি এই তিন যাত্রীর গল্প অনলাইনে ছড়িয়ে দেন, যা বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের মন ছুঁয়ে যায় এবং ব্যাপক সহানুভূতি ও সহায়তা পেতে শুরু করেন তাঁরা।

এরপর তাঁরা স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, বসনিয়া ও সার্বিয়া হয়ে আগাতে থাকেন। বসনিয়ায় মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে তাঁদের হৃদয়গ্রাহী অভ্যর্থনা জানানো হয়। মানুষ তাঁদের খাদ্য, পোশাক, এমনকি ঘোড়ার জন্য নগদ অর্থও দেন।

সার্বিয়া পেরিয়ে, বিধিনিষেধের কারণে বুলগেরিয়া অংশ গাড়িতে অতিক্রম করতে হয়। এরপর তুরস্কে পুনরায় ঘোড়ায় চড়েন। রমজান মাসে তুরস্কে তাঁদের অভ্যর্থনা ছিল বিস্ময়কর। পুলিশ থেকে শুরু করে স্থানীয় জনগণ ইফতারের জন্য তাঁদের প্রতিদিন খাবার দিতেন। হারনান্দেজ বলেন, “তুরস্কে প্রবেশের পর থেকে আর রান্না করতে হয়নি।”

পরবর্তী গন্তব্য ছিল যুদ্ধপীড়িত সিরিয়া, যেখানে তাঁরা সিরিয়ার সংস্কৃতিমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে অভ্যর্থনা পান। এরপর জর্ডানের মরুভূমি অতিক্রম করে তাঁরা সৌদি আরবে প্রবেশ করেন এবং পবিত্র হজ পালন করেন।

এই ব্যতিক্রমধর্মী যাত্রা শুধু শারীরিক সাহসের গল্প নয়, এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, বিশ্বাস ও মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।