
ইসরায়েলের বিমান হামলার পাল্টা জবাবে যখন ইরান ‘ট্রু প্রমিস–৩’ নামে সামরিক অভিযান শুরু করে, তখন বিশ্ব শক্তিগুলো এক অদৃশ্য রেখা দিয়ে দু’ ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। গ্লোবাল সাউথের অনেক দেশ ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও বেশিরভাগ পশ্চিমা দেশ থেকেছে নীরব। তবে কয়েকটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও গোষ্ঠী প্রকাশ্যে ইরানের পাশে দাঁড়িয়েছে—কেউ নীতিগতভাবে, কেউ কূটনৈতিকভাবে, কেউবা প্রতিরোধের নাম করে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়েছে।
রাশিয়া এই ঘটনায় প্রথম প্রতিক্রিয়া জানায়। মস্কো ইসরায়েলের হামলাকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপর সরাসরি আগ্রাসন বলে আখ্যা দেয়। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, তারা ইরানের আত্মরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় এবং তেহরানের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। ইউক্রেনে পশ্চিমা জোটের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া রাশিয়ার জন্য ইরানের প্রতি এমন সমর্থন তাদের বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ বলেই মনে করা হচ্ছে।
চীনও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেয়। জাতিসংঘে দেওয়া বক্তব্যে চীনা প্রতিনিধি ফু কং বলেন, ইসরায়েলের হামলা আন্তর্জাতিক আইন এবং রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন। চীন ইরানের পাল্টা হামলাকে ‘বৈধ আত্মরক্ষা’ বলে স্বীকৃতি দেয় এবং যুক্তরাষ্ট্রকে এই উত্তেজনার জন্য দায়ী করে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে ইরানের অংশগ্রহণ এবং মার্কিন প্রভাব হ্রাস চীনের এই অবস্থানের পেছনে বড় কারণ।
মধ্যপ্রাচ্যের ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্স’ হিসেবে পরিচিত গোষ্ঠীগুলো—যেমন হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুথি, ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া ও হামাস—ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি হামলার দাবি করেছে। এদের অনেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া ও সাইবার হামলা চালানোর কথাও জানিয়েছে। ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে এই গোষ্ঠীগুলোর সক্রিয়তা যুদ্ধকে আরও বিস্তৃত আকার দেওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।
ল্যাটিন আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলাও মুখ খুলেছে। প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এক বিবৃতিতে বলেন, ইরানে ইসরায়েলের হামলা ‘নব্য-নাৎসি ইহুদিবাদ’ এবং এটি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনকারী একটি অপরাধমূলক আক্রমণ। মাদুরো আরও বলেন, ‘যুদ্ধকে না, ফ্যাসিবাদকে না, নব্য-নাৎসি ইহুদিবাদকে না বলুন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে তিনি একবিংশ শতাব্দীর হিটলার বলেও আখ্যা দেন।
পাকিস্তানও এই সংঘাতে ইরানের পাশে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ পার্লামেন্টে বলেন, পাকিস্তান ইরানের পাশে আছে এবং আন্তর্জাতিক সব ফোরামে ইরানকে সমর্থন দেবে। তিনি মুসলিম দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে এবং জরুরি ওআইসি বৈঠকের মাধ্যমে সমন্বিত কৌশল নির্ধারণ করতে। একইসঙ্গে উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার ইরানের ওপর হামলাকে ‘সার্বভৌমত্বের নির্লজ্জ লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করেন।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে—ইরানকে যারা প্রকাশ্যে সমর্থন দিচ্ছে, তারা কী কেবল বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বাস্তব কোনো পদক্ষেপ নেবে? যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে—কে কার পক্ষে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, এই বন্ধুরা কি সত্যিই ইরানের পাশে দাঁড়াবে, না কি এ সমর্থন কেবল কথার ফুলঝুরি হয়েই থাকবে?