ডেঙ্গুতে হঠাৎ ঊর্ধ্বগতি, অদৃশ্য কারণ নিয়ে প্রশ্ন
ছবিঃ বিপ্লবী বার্তা

শীতকালেও বরগুনায় এডিস মশার লার্ভার অস্বাভাবিক উপস্থিতি গবেষকদের উদ্বিগ্ন করেছে। শুধু বরগুনা নয়, বরিশাল বিভাগের অন্যান্য এলাকায়ও এমন পরিস্থিতি দেখা গেছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (সিডিসি) যৌথভাবে একটি জরিপ পরিচালনা করে।

জরিপে অংশ নেওয়া এক গবেষক জানান, এইবার এডিসের লার্ভা যেসব স্থানে পাওয়া গেছে, তা বেশ অস্বাভাবিক ও নতুন ধরনের। বিশেষ করে পানি সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত বড় বড় মটকা এবং প্লাস্টিকের পাত্রে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখার কারণে সেখানে এডিসের বংশবিস্তার ঘটছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি শুধু গ্রাম নয়, পৌর এলাকার কিছু অংশেও লক্ষ্য করা গেছে।

এটি স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে নতুন তথ্য উপস্থাপন করেছে। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, পানির সংকটজনিত কারণে ডেঙ্গুর বিস্তার একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ নীতিতে পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে।

একসময় বরগুনাসহ দক্ষিণাঞ্চলে জমা পানিতে মশা প্রতিরোধে মাগুর বা জিওল মাছ ছেড়ে দেওয়া হতো, যেগুলো লার্ভা খেয়ে ফেলত। কিন্তু এই প্রথাগত জ্ঞান এখন আর ব্যবহার করা হয় না বলে উল্লেখ করেন আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটারএইড-এর দক্ষিণ এশীয় প্রধান ডা. খায়রুল ইসলাম। তিনি বলেন, পানির সংকট থাকলেও আমরা আমাদের ইতিবাচক চর্চাগুলো হারিয়ে ফেলেছি।

বরগুনায় সুপেয় পানির ঘাটতি প্রকট। জেলা ডিপিএইচই কার্যালয়ের তথ্যমতে, জেলাটির ৪০ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি পায় না। বিশেষ করে সদর উপজেলার নলটোনা ও বালিয়াতলী ইউনিয়নে সুপেয় পানির কোনো সরকারি উৎস নেই। এর পেছনে ভূপ্রাকৃতিক কারণ ও লবণাক্ততা প্রধান ভূমিকা রাখছে। কোথাও কোথাও টিউবওয়েল স্থাপন করা হলেও পানি ওঠে না, কারণ পানির স্তর অনেক নিচে।

তবে শুধু বরগুনা নয়, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জেও আগের জরিপে একই ধরনের চিত্র পাওয়া গেছে। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, গাজীপুরে ১৪.২৮% এবং নারায়ণগঞ্জে ১৩.৪৭% বাড়িতে লার্ভা পাওয়া যায়, যেখানে পানির সংকট রয়েছে।

সাধারণত উপকূলীয় এলাকায় মশার প্রাদুর্ভাব কম হয় বলে ধরা হয়, কারণ সাগরের প্রবল বাতাস এবং লোনা পানি এডিস মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করে। তবে কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার জানান, যদি পানির লবণাক্ততা ১২ পিপিটির নিচে নেমে আসে, তবে এডিস মশা সেখানে বংশবিস্তার করতে পারে। বরগুনার পানির লবণাক্ততা অনেক সময় এমন অবস্থায় পৌঁছায়।

আইইডিসিআরের পরিচালক ডা. তাহমিনা শিরিনও স্বীকার করেছেন, বরগুনায় পানি ধরে রাখার পাত্রে লার্ভা পাওয়া গেছে। তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বরগুনাসহ উপকূলীয় এলাকায় ডেঙ্গুর বিস্তার এবং পানির সংকটের মধ্যে এক ধরনের সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে। এই সংকট থেকে উত্তরণে প্রথাগত জ্ঞান এবং আধুনিক উদ্যোগ—উভয়ের সমন্বয় জরুরি। ডা. খায়রুল ইসলাম মনে করেন, উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির নিশ্চয়তা ও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রথম অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। এজন্য রাষ্ট্রের সক্রিয় হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।