
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বুড়ি পোতাজিয়া এলাকায় চলনবিলের শেষ অংশে শতাধিক খাল, বিল এবং বড়াল নদীসহ অর্ধশতাধিক নদীর পানি মিলিত হয়। এই জলপ্রবাহ শেষ পর্যন্ত যমুনা নদীতে প্রবাহিত হয়। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই পানিপ্রবাহের স্থানে স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।
পরিবেশ ও পানি বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, কংক্রিটের স্থাপনা নির্মাণ করলে চলনবিলের জলজ বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাশাপাশি, পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হলে আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা ও বন্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১৬ সালে পাশ হয়। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে ক্লাস শুরু হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচটি বিভাগে ১,২০০ শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। শিক্ষক আছেন ৩৪ জন এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ১৬১ জন। সাত বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় শহরের বিভিন্ন ভাড়া ভবনে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবির পর স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য শাহজাদপুর শহর থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার দূরে বুড়ি পোতাজিয়ার ১০০ একর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে। ক্যাম্পাস নির্মাণের অনুমোদনের দাবিতে শিক্ষার্থীরা কয়েক দফা সড়ক অবরোধও করেছেন।
সরকারি একটি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত স্থানের ৪ মাস বর্ষাকালে পানির নিচে থাকে। ক্যাম্পাস নির্মাণে ৯–১৪ মিটার উচ্চতায় ৩৬ লাখ ৬১ হাজার ৬৩০ ঘনমিটার বালু লাগবে। যাতায়াতের জন্য সড়ক ও সেতু নির্মাণ, পানির ঢেউ প্রতিরোধে বাঁধ নির্মাণের ব্যয় হবে ৪৪৮ কোটি টাকা। মোট ব্যয় হবে ৯৬৭ কোটি টাকা। ইতিমধ্যেই ৪ একর জায়গা ভরাট করা হয়েছে, যা বড়াল নদীর পানিপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে।
শুষ্ক মৌসুমে এই জায়গা গোচারণ ভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ক্যাম্পাস স্থাপিত হলে গোচারণ ভূমি ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। কিছু পক্ষ মনে করেন, ক্যাম্পাসটি সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক এলাকায় স্থাপন করা যেতে পারে। এখানে ১,১৫৬ একর জমি উপলব্ধ।
উপাচার্য অধ্যাপক এস এম হাসান তালুকদার বলেন, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বলা হয়েছে, এটি রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত স্থানে স্থাপন করতে হবে। চলনবিলের পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগের জবাবে তিনি জানান, প্রস্তাবিত এলাকা চলনবিলের কেন্দ্রস্থল থেকে ৬৮ কিলোমিটার দূরে এবং এটি বিল শ্রেণিভুক্ত নয়। পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১৯ সালে ছাড়পত্র দিয়েছে। প্রকল্প পরিকল্পনায় দুটি লেক ও তিনটি পুকুর রাখা হয়েছে।
চলনবিল রক্ষা আন্দোলন কমিটির সদস্যসচিব এস এম মিজানুর রহমান বলেন, “আমরাও চাই বিশ্ববিদ্যালয় হোক, কিন্তু চলনবিলের পানি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং পূর্বের অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের কারণে এটি ইতিমধ্যেই সংকটে। বুড়ি পোতাজিয়ায় ক্যাম্পাস হলে চলনবিলের ক্ষতি হবে।”
চলনবিলে ৬ জেলা ও ৪১ উপজেলার ১,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রয়েছে। এখানে ৪৭টি নদী, ৩ শতাধিক খাল এবং ১ লাখ ২০ হাজার অবৈধ খনন করা পুকুর আছে। চলনবিলে ১০৫ প্রজাতির দেশি মাছ, ২৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৭ প্রকার উভচর, ৩৪ প্রজাতির পাখি এবং অসংখ্য জলজ উদ্ভিদ বাস করে।
সরেজমিন বুড়ি পোতাজিয়ায় দেখা যায় চারপাশে পানি, মাঝখানে দ্বীপের মতো অংশে প্রস্তাবিত ক্যাম্পাসের সাইনবোর্ড। স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য মাটি ফেলা হয়েছে। বছরের ছয় মাস এলাকার চারপাশ পানিতে ডুবে থাকে।
বুয়েটের পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আতাউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, “পানি আইনে বলা আছে, জলস্রোতের ধারা বাধাগ্রস্ত করে স্থাপনা নেওয়া যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের আগে পরিবেশগত সমীক্ষা ও সম্ভাব্য প্রভাব যাচাই করা জরুরি।”
এস কে আর