দেশের অন্যতম ভারী রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কেরু চিনিকলে ১০৪ জন শ্রমিক ও কর্মচারীকে মৌসুমি থেকে স্থায়ী করার ক্ষেত্রে বড় অংকের ঘুষ বাণিজ্য, দায়িত্বে অবহেলা, অনিয়ম ও অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মিলের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ ১০ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি)।
রোববার (১৪ ডিসেম্বর) দর্শনা কেরু চিনিকলে করপোরেশন সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক চিঠি পৌছানোর পর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দীর্ঘ তদন্ত ও নথিপত্র পর্যালোচনার পর অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে লঘুদণ্ড আরোপ করা হয়েছে।
কেরু চিনিকল সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে এই মিলটিতে মৌসুমি শ্রমিক-কর্মচারীদের স্থায়ী করার কার্যক্রম বন্ধ ছিল। ২০২৩ সালের মে মাসের প্রথম দিকে দেশের সব চিনিকলের মৌসুমি শ্রমিক ও কর্মচারীদের স্থায়ী করার একটি প্রস্তাব বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের সদর দপ্তরে পাঠানো হলে তা অনুমোদিত হয়।
এই সিদ্ধান্তের আলোকে সারা দেশের চিনিকলগুলোতে একযোগে ১৩ ও ১৪ মে ২০২৩ তারিখে লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। কেরু চিনিকলে ১৪০ জন মৌসুমি শ্রমিক ও কর্মচারী স্থায়ী হওয়ার লক্ষ্যে পরীক্ষায় অংশ নেন।
পরীক্ষার পরপরই অভিযোগ ওঠে, স্থায়ীকরণে মেধাবীদের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে এবং মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংরক্ষণ করা হয়নি। এ অভিযোগে বঞ্চিত দুই কর্মচারী বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশন লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন এবং আদালতে মামলা করেন।
এরই মধ্যে তৎকালীন চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের সচিব চৌধুরী শহিদুল্লাহ কাইছার ১৫ মে ২০২৩ তারিখে কেরু চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর এক জরুরি পত্রে স্থায়ীকরণ সংক্রান্ত সব কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। দেশের সব চিনিকল ওই নির্দেশনা মেনে চললেও কেরু চিনিকল কর্তৃপক্ষ তা উপেক্ষা করে।
অভিযোগ রয়েছে, পরীক্ষার মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কেরু চিনিকল কর্তৃপক্ষ ১৪০ জনের মধ্যে ১০৪ জনকে উত্তীর্ণ দেখিয়ে স্থায়ী নিয়োগ সম্পন্ন করে। এ ঘটনায় বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়।
১৭ মে ২০২৩ তারিখে তৎকালীন কর্পোরেশন চেয়ারম্যান শেখ শোয়েবুল আলম (এনডিসি) কেরু চিনিকলের তৎকালীন এমডি মোশাররফ হোসেনকে কৈফিয়ত তলব করেন। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার কারণ জানতে তিন কার্যদিবসের মধ্যে ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
ঘটনার পর কর্পোরেশন ও শিল্প মন্ত্রণালয় পৃথক পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে কেরু চিনিকলে তদন্ত পরিচালনা করে। সব তদন্ত প্রতিবেদন, অভিযুক্তদের জবাব, কারণ দর্শানোর নোটিশ ও বিভাগীয় মামলার নথি পর্যালোচনা শেষে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ও বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান রশিদুল হাসানের স্বাক্ষরিত চিঠিতে জানানো হয়, তৎকালীন কেরু চিনিকলের এমডি মো. মোশারফ হোসেন, সদর দপ্তরের কর্মকর্তা সাইফুল আলম, কেরু চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মো. ইউসুফ আলী এবং লেবার অফিসার মো. আল আমিনের বিরুদ্ধে কর্পোরেশন কর্মচারী চাকরি প্রবিধিমালা ১৯৮৯ এর প্রবিধি ৩৯(১)(খ)(অ) অনুযায়ী গুরুদণ্ড আরোপের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আদেশ জারির তারিখ থেকে আগামী ৩০ জুন ২০২৮ পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধি স্থগিত রাখাকে সূচক লঘুদণ্ড হিসেবে কার্যকর করা হয়েছে।
এ ছাড়া কেরু চিনিকলের মহাব্যবস্থাপক (অর্থ) আব্দুস ছাত্তার, মহাব্যবস্থাপক (কারখানা) সুমন কুমার সাহা, মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) আশরাফুল আলম ভূইয়া, মহাব্যবস্থাপক (ডিস্টিলারি) রাজিবুল হাসান, খামার ব্যবস্থাপক সুমন কুমার এবং পরিবহন বিভাগের প্রকৌশলী আবু সাঈদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে।
কর্পোরেশন সূত্র জানায়, 'প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ, তদন্ত প্রতিবেদন ও নথিপত্র পর্যালোচনায়, ঘুষ বাণিজ্য, দায়িত্বে অবহেলা ও অসদাচরণের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। নির্ধারিত মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বেতন বৃদ্ধি গণনা করা যাবে না।'
এ বিষয়ে দর্শনা কেরু চিনিকলের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসান (এফসিএমএ) বলেন, 'এ সংক্রান্ত একটি চিঠি ঢাকা সদর দপ্তর থেকে পাওয়া গেছে। তবে ১০৪ জন কর্মচারীর বিষয়ে এখনো কোনো নতুন নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। সদর দপ্তর যেভাবে নির্দেশনা দেবে, সেভাবেই পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'

