দেশের গ্রামগঞ্জ একসময় ছিল শিশু-কিশোরদের অবাধ খেলাধুলার রাজ্য। বিকেলের হাওয়া লাগতেই দলে দলে ছেলেমেয়েরা ছুটে যেত মাঠে। গ্রামের বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠ, গাছতলার খোলা জায়গা আর পাড়ার ছেলেদের ডাক সব মিলিয়ে প্রাণবন্ত হয়ে উঠত গ্রামীণ জীবন। কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়ায়, প্রযুক্তির প্রভাব ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে সেই সোনালি দিনগুলো। কাবাডি, গোল্লাছুট, মারবেল খেলা, কুতকুত খেলা, লুকোচুরি, দড়িলাফের মতো লোকজ খেলা এখন অতীতের গল্প হয়ে গেছে।
একসময় গ্রামবাংলার সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ খেলাগুলোর একটি ছিল কাবাডি। শক্তি, সহনশীলতা, কৌশল আর সাহসের সমন্বয়ে এই খেলাটি গ্রামীণ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। গ্রামের ছেলেরা দলবেঁধে মাঠে নামত, খেলা হতো এক পাড়ার সাথে আরেক পাড়ার, গ্রামের মানুষও ভিড় জমাত খেলা দেখতে। এখন সেই মাঠ নেই যা আছে তা দখল হয়ে যাচ্ছে বাড়িঘর, গুদাম বা বিভিন্ন স্থাপনায়।
গোল্লা খেলা ছিল গ্রামের শিশুদের সবচেয়ে প্রিয় খেলা। স্কুল ছুটি হলেই দৌড়ঝাঁপ, হাসি-আনন্দ আর মুক্ত পরিবেশে বড় হয়ে ওঠার এক চমৎকার সুযোগ ছিল এই খেলা। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তন, প্রযুক্তির আকর্ষণ এবং নিরাপত্তাজনিত নানা কারণে আজকের শিশুরা মাঠের খেলা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে সখীপুর উপজেলার আড়াই পাড়া গ্রামের মাঈন উদ্দিন (৭০) বলেন, 'আমাদের সময়ে বিকেল মানেই ছিল মাঠ। গোল্লা খেলতে খেলতে সূর্য ডুবে যেত, তবু বাড়ি ফিরতে মন চাইত না। এখনকার বাচ্চাদের দিকে তাকালে মন খারাপ হয় খেলার সাথী নেই, শুধু মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকে।'
জাককানইবি'সাসের সাবেক সভাপতি রাশেদুজ্জামান রনি বলেন, 'মাঠভিত্তিক এসব লোকজ খেলাধুলা শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মাঠে দৌড়ানো, লাফানো, দলবেঁধে খেলা এসবই শিশুদের আত্মবিশ্বাস, বন্ধুত্ব এবং যোগাযোগ দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে।'
তিনি বলেন, 'কিন্তু গ্রামের জমি সংকুচিত হওয়া, বসতবাড়ি বাড়া, মানুষজনের ব্যস্ততা ও প্রযুক্তির প্রভাব শিশুদের মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। অভিভাবকদেরও ভয় বাইরে খেলতে গেলে দুর্ঘটনা বা ঝুঁকি হতে পারে। লোকজ খেলা হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু একটি বিনোদন হারিয়ে যাওয়া নয়। এর সাথে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি, সমাজবন্ধন এবং মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগের মেলবন্ধন। এখনই যদি মাঠ রক্ষা, খেলার জায়গা নিশ্চিত করা এবং শিশুদের মাঠমুখী করতে সচেতনতা না বাড়ানো যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেবল গল্পের বইতেই শুনবে কাবাডি আর গোল্লা খেলার নাম গ্রামের মাঠে সেই দৃশ্য আর কখনো ফিরে আসবে না।'

