
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় (ইবি) আন্তঃসেশন খেলাকে কেন্দ্র করে অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটেছে। এসময় ভিডিও করতে গেলে সাংবাদিকের মোবাইল কেড়ে নিয়ে মারধর করা হয়।
শনিবার (১২ জুলাই) বিকেল পাঁচটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ফুটবল মাঠে এই ঘটনা ঘটে। এদিকে ঘটনার ধামাচাপা দিতে মেয়ে শিক্ষার্থীকে ভিকটিম সাজিয়ে ইস্যু তৈরীর চেষ্টা করছে বিভাগটির শিক্ষার্থীরা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ফুটবল মাঠে অর্থনীতি বিভাগের আন্তঃসেশন খেলা চলছিলো। খেলাকে কেন্দ্র করে নিজেদের ভিতরে হাতাহাতিতে জড়ান বিভাগটির সিনিয়র ও জুনিয়ররা। এসময় তাদের মারামারির ভিডিও করতে যান ক্যাম্পাস সাংবাদিক আরিফ বিল্লাহ। এসময় আচমকা তার মোবাইল কেড়ে নেন বিভাগের ছাত্র আফসানা পারভীন তিনা। একইসময় দলবেঁধে তেড়ে এসে সেই সাংবাদিককে এলোপাথাড়ি মারধর শুরু করেন বিভাগটির অন্য শিক্ষার্থীরা। এসময় আশেপাশের কয়েকজন ঠেকাতে গেলে তাদেরকেও ঘিরে ধরে মারধর করা হয়।
পরবর্তীতে নুর ই আলম নামে আরেক সাংবাদিক মারধরের ভিডিও করতে গেলে তাকেও মারধর করা হয়। সেখানে উপস্থিত থাকা রবিউল আলম নামে আরেক সাংবাদিকও মারধরের শিকার হন। পরবর্তীতে সেখানে অন্য সাংবাদিকরা সমাধানের জন্য গেলে তাদের সঙ্গে বাকবিতন্ডার সৃষ্টি হয়। পরবর্তী কয়েকজন সাংবাদিক উত্তেজিত অবস্থায় তাদের দিকে গেলে তাদেরকেও মারধর করেন অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
এই ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা হলেন, অর্থনীতি বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের নাহিদ হাসান, সাব্বির, আফসানা পারভিন তিনা, মিনহাজ, সৌরভ দত্ত ও পান্না এবং একই বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের অজিল, সাইফুল, রাকিব, মশিউর রহমান রিয়ন ও হৃদয়।
এদিকে এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মরত সাংবাদিকরা, প্রক্টর ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক মাঠে উপস্থিত হন। ভুক্তভোগীরা জানান, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে এ ধরনের হামলা কাম্য নয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে সুষ্ঠু বিচার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানাই। এছাড়াও এ ঘটনায় প্রায় চার ঘন্টা পার হয়ে গেলেও ছিনিয়ে নেওয়া মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করা যায়নি।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক এস এম সুইট, রোভার খন্দকার সায়েম এবং ডিবিসি প্রতিনিধি নাজমুল হোসেন। তারা জানান, তাদের সামনেই সাংবাদিককে মারধর করা হয়। পরে আহতদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।
এদিকে বিষয়টিকে ধামাচাপা দিতে নতুন ইস্যু তৈরীর চেষ্টা করছে বিভাগটির শিক্ষার্থীরা। তারা অভিযোগ করছেন, প্রক্টরের সামনে তাদের বিভাগের আফসানাকে সাংবাদিক মারধর করেছে। এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছে ওই ছাত্রীকে।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ওই ছাত্রীকে মারধরের মতো কোন ঘটনা ঘটেনি।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের দায়িত্বরত চিকিৎসক ডা. সাহেদ আহম্মেদ বলেন, ছাত্রীর গায়ে কোন আঘাত লাগার চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তবে আতঙ্কগ্রস্থ বা প্যানিক অ্যাটাকে এমন হতে পারে।
এ ছাড়া মেডিকেল সেন্টারের একাধিক সূত্র জানায়, মেয়েটিকে স্বাভাবিকই মনে হয়েছে। আক্রান্ত না হয়েও সে আক্রান্তের অভিনয় করছে বলে মনে হচ্ছে।
এই বিষয়ে প্রক্টর অধ্যাপক ড. শাহীনুজ্জামান বলেন, আমি ঘটনাটি শোনার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে সবাইকে নিবৃত করি। লিখিত অভিযোগ করা হলে ব্যবস্থা নেবো।
আপনার সামনে মেয়েকে মারধর করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে প্রক্টর বলেন, আমি এই বিষয়ে কিছু জানিনা।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী ইশতিয়াক ফেরদৌস ইমন বলেন, ‘আমি হট্টগোলের আওয়াজ শুনে মাঠের দিকে এগিয়ে যায়। গিয়ে দেখি কয়েকজন মিলে একজন সাংবাদিককে মারধর করছে। তার পাশে আরেক সাংবাদিক ভিডিও করতে গেলে তাকেও ভিডিও বন্ধ করতে বলা হয়। ভিডিও বন্ধ না করায় তাকে এসে লাথি মারা হয়।'
ভুক্তোভোগী শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক নুর ই আলম বলেন, আজকে ফুটবল মাঠে ইকোনোমিকস বিভাগের আন্তঃসেশন খেলায় মারামারির ঘটনা ঘটলে এক সহকর্মী আরিফ বিল্লাহ সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে মারধরের শিকার হয়। তখন আমি ক্যামেরা নিয়ে ভিডিও করতে গেলে আনুমানিক ১৫-২০ জন এগিয়ে এসে আমাকে ক্যামেরা বন্ধ করতে বলে মারধর করে। এসময় কয়েকজন এসে আমাকে উদ্ধার করে। এর কিছুক্ষণ পরে অন্য সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে আসলে তাদের ওপর ফের হামলা চালায় তারা। আমি হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
ভুক্তোভোগী আরেক শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক আরিফ বিল্লাহ বলেন, বিকেল ৫ টার দিকে আমি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে দেখি ফুটবল মাঠে দুই পক্ষের হাতাহাতি ও মারামারি চলছে। ঘটনা দেখে আমি সংবাদের সংগ্রহের জন্য মোবাইল নিয়ে ভিডিও করা শুরু করি। হঠাৎ এক মেয়ে এসে আমার মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। আমি মোবাইল কেড়ে নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সাথে সাথে ৮/১০ টা ছেলে এসে আমাকে ঘীরে ধরে চর, থাপ্পর, ঘুষি মারা শুরু করে। সাথে সাথে সাংবাদিক নুর এসে আমাকে মারার ভিডিও করলে তাকেও ২০/২৫ টা ছেলে মারধর করে। এসময় কয়েকজন আমাকে উদ্ধার করতে আসলে তাদের সামনে আমাকে ফের মারধর করে। আমি কোনরকম ছুটে এসে সাংবাদিক রবিউলকে ডেকে নেই। রবিউল ঘটনাস্থলে যাওয়ার সাথে সাথে রবিউলকে চড় থাপ্পর ঘুষি ও লাথি মারা শুরু করে। এতে রবিউল মাটিতে পড়ে যায়। পরে কয়েকজন ওদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিরাপদে নিয়ে আসে। ওরা আমার ফোন এখনো ফেরত দেয় নি। এর কিছুক্ষণ পরে অন্য সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে আসলে ফের তারা হামলা চালায়।
ভুক্তভোগী সাংবাদিক রবিউল জানান, আমি বিকাল ৫ টার সময় অফিসে অবস্থান করছিলাম। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুটবল মাঠে অর্থনীতি বিভাগের আন্ত:সেশন ফুটবল খেলা চলছিলো। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মারামারির ভিডিও করতে গেলে সাংবাদিক আরিফ বিল্লাহ হামলার শিকার হন। বিষয়টি জানতে পেরে সেখানে গেলে দেখি আরিফ বিল্লাহকে তারা ঘিরে রেখেছে। ওই সময় ভিডিও ধারণের প্রস্তুতি নিতে থাকলে কয়েকজন এসে মোবাইল কেড়ে নেওয়ার জন্য উদ্যত হয়। আমি বলেছিলাম ‘আমি সাংবাদিক এভাবে আপনারা চার্জ করতে পারেন না।’ তখন কয়েকজন ‘তার মোবাইল কেড়ে নে, ওরে ধর, ভিডিও থাকলে ডিলিট দে’ বলে চারদিক থেকে এলোপাতাড়ি কিল ঘুষি মারে। বিশেষ করে অর্থনীতি বিভাগের ২০২০-২১ বর্ষের নাহিদ ইসলাম আমার তলপেটে লাথি মারে। তখন আমি মাটিতে পড়ে যাই। এসময় সমন্বয়ক সুইট, রব্বানী ভাইসহ কয়েকজন আমাকে উদ্ধার করে। তিনি আরও জানান, এর আগে গত ২০ এপ্রিল একটি সংবাদ প্রকাশের জেরে আমাকে দেখে নেওয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন নাহিদ। পেশাদারি কাজে বাঁধা প্রদান এবং মারধরের ঘটনায় আমি যথাযথ বিচার এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের জোর দাবি জানাচ্ছি।
এদিকে ঘটনার চার ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও ভুক্তভোগী সাংবাদিক ফোন ফেরত পাননি। এদিকে ওই ছাত্রীকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে অভিযুক্তদের একজন অর্থনীতি বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী নাহিদ হাসান বলেন, আমাদের বিভাগের আন্তঃসেশন খেলা হচ্ছিল। তখন বল আউট হওয়া না হওয়া নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝামেলা হয়। জুনিয়র একজন স্যরি বলে সমাধান করা হয়। এসময় আমি সাংবাদিক কাউকে মারিনি। আমার গলা ধরছে তখন আমি কি করব।’ এ কথা বলেই তিনি উত্তেজিত হয়ে প্রতিবেদকের কল কেটে দেন।
অর্থনীতি বিভাগের সভাপতি ড. পার্থ সারথি লস্কর বলেন, আজকে অর্থনীতি বিভাগের আন্তঃশিক্ষাবর্ষ খেলা ছিল। সেখানে ২০১৯-২০,২০২০-২১, ২০২১-২২, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের খেলা ছিল। শুনেছি মারামারি ঘটনা ঘটেছে। তবে সেখানে ঠিক কি হয়েছে জানি না। বিষয়টি নিয়ে বসে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম. এয়াকুব আলী বলেন, সাংবাদিকদের অবমাননা করা উচিত হয়নি। প্রশাসনকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবগত করলে তদন্তপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সাংবাদিকদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ ছাড় দেয়া হবে না। সাংবাদিকদের কারণেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ভালো আছে। সাংবাদিকদের তাদের পেশাগত দায়িত্ব সম্মানের সাথে পালনের সুযোগ দেয়া উচিত। এক্ষেত্রে সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় প্রশাসনেরও সহযোগিতা করা উচিত।