 
      ১লা জুলাই ২০২৫। ঠিক এক বছর আগে আজকের এই দিনে গর্জে উঠেছিল রাজু ভাস্কর্যের চত্বর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়ে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছড়িয়ে পড়েছিল আন্দোলনের আগুন। স্লোগান ছিল সেই পুরনো—“কোটাব্যবস্থা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক।”
শিক্ষার্থীদের একটাই দাবি—সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন পুনর্বহাল করতে হবে।
২০১৮ সালের মার্চ মাসে যখন সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। তারা বলেছিল—কোটার সংখ্যা কমাতে হবে, শূন্যপদে নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে এবং সবার জন্য অভিন্ন বয়সসীমা নিশ্চিত করতে হবে।
সে সময় কোটা কাঠামো ছিল ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য, ২০ শতাংশ নারী ও অনগ্রসর জেলার জন্য, ৫ শতাংশ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য এবং ১ শতাংশ শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য। ছাত্রসমাজের ভাষায় এটি ছিল "মেধা-বঞ্চনার প্রতীক।"
২০১৮ সালের ২১শে মার্চ সংসদে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন—কোটা বহাল থাকবে। এরপরেই দেশজুড়ে শুরু হয় ক্লাস বর্জন, বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে শাহবাগে পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের তুমুল সংঘর্ষে আহত হন অন্তত ৭৫ জন। উত্তপ্ত হয়ে পড়ে রাজধানীর প্রধান কেন্দ্রস্থল।
চাপের মুখে ১১ই এপ্রিল শেখ হাসিনা কোটা পদ্ধতি বাতিলের ঘোষণা দেন। ৩রা অক্টোবর তৎকালীন সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে জানায়—নবম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিল করা হলো। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কোটা বহাল থাকবে।
কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিয়েও বিতর্কের ইতি ঘটেনি। ২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন হাইকোর্টে রিট করেন এবং কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপনকে চ্যালেঞ্জ জানান।
দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে ২০২৪ সালের ৫ই জুন হাইকোর্ট রায় দেয়—২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্র আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত। অর্থাৎ ওই প্রজ্ঞাপন অবৈধ। এই রায়ের মধ্য দিয়ে খুলে যায় কোটা পুনর্বহালের সম্ভাবনার দ্বার।
সেদিন রাতেই ঢাবি ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ শুরু হয়। ৬ই জুন রাজু ভাস্কর্যে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীরা জানান দেয়, “২০১৮ সালের রক্ত, ঘাম, চোখের জল বৃথা যেতে দেব না।” একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও প্রতীকী অবরোধ কর্মসূচি পালন করে।
৯ই জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সরকারকে ৩০ জুন পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়ে আলটিমেটাম দেয়—হাইকোর্টের রায় কার্যকর না করে বরং ২০১৮ সালের প্রজ্ঞাপন পুনর্বহাল করতে হবে, অন্যথায় চলবে সর্বাত্মক আন্দোলন।
১লা জুলাই ২০২৪, আলটিমেটামের প্রথম দিনেই আন্দোলনে জেগে ওঠে ছাত্রসমাজ। ঢাবি, জাবি, রাবি, ববি, চবি—প্রায় সকল খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হয় সমাবেশ, মিছিল, প্রতীকী অবরোধ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে গ্রন্থাগার থেকে শুরু হয়ে কলাভবন, মলচত্বর হয়ে মিছিল যায় রাজু ভাস্কর্যে। প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল—“কোটাব্যবস্থা নিপাত যাক”, “মেধাবীদের কান্না আর না”, “মেধার অপমান মানব না”, “আঠারোর হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার।”
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও শহীদ মিনারে সমাবেশ করে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে ১০ মিনিটের প্রতীকী অবরোধ পালন করেন। একই সময় রাবিতে চলে দ্বিতীয় দিনের মানববন্ধন।
২০১৮ সালে যে আন্দোলন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিলের ইতিহাস লিখেছিল, ২০২৪ সালের জুন-জুলাইয়ে ফের সেই আন্দোলনের চেতনাই ফিরিয়ে আনে ছাত্রসমাজ। শুধু মুখ ও নেতৃত্ব বদলেছে, কিন্তু দাবি ও লড়াইয়ের ভাষা বদলায়নি।
২০২৫ সালের এই ১লা জুলাই কেবল একটি তারিখ নয়—এটি ছাত্র আন্দোলনের দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতীক, একটি প্রজন্মের ন্যায্যতার দাবিতে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকার স্মারক।
 নিজস্ব প্রতিবেদক
                     নিজস্ব প্রতিবেদক 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                 
                                
